বাংলা বা বাঙ্গালাহ (ইংরেজি: Bangla or Bengal) নামের উৎপত্তি হয়েছে বঙ্গ শব্দের সাথে আল বা আইল শব্দ যুক্ত হয়ে। ‘বঙ্গ’ নামটিই শেষ পর্যন্ত বৃহৎ আকারে ‘বাঙ্গালা’ নামে রূপান্তরিত হয়। অনেকে বঙ্গকে চীন তিব্বতী গোষ্ঠীর শব্দ এবং এ শব্দের ‘অং’ অংশের সঙ্গে গঙ্গা, হোয়াংহো, ইয়াংসিকিয়াং ইত্যাদি নদীর নামের সম্বন্ধ ধরে অনুমান করেন যে, শব্দটির মৌলিক অর্থ ‘জলাভূমি’ এবং ‘বঙ্গ’ নামের উদ্ভব হয়েছে বাংলার অসংখ্য নদ-নদী, বিল-হাওড়ের বাস্তব ভৌগোলিক অবস্থা থেকে।
সুপ্রাচীনকালে বাংলার ছিল কৌমভিত্তিক চেতনা, স্বতন্ত্র কিছু জনপদ, ঐক্য তখনও বাংলায় আসেনি; বঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল, গৌড়সহ বিভিন্ন সময়ের বাংলার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল।
সামন্তবাদী যুগের মোগল আমলের ঐতিহাসিক আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বলেন, “বাঙ্গালার আদি নাম ছিল বঙ্গ। এখানকার রাজারা প্রাচীনকালে ১০ গজ উঁচু এবং ২০ গজ প্রশস্ত প্রকান্ড ‘আল’ নির্মাণ করতেন। এ থেকেই ‘বাঙ্গাল’ এবং ‘বাঙ্গালাহ’ নামের উৎপত্তি।” নদীমাতৃক, বারিবহুল এবং বন্যা ও জোয়ারের দেশে ছোট বড় ‘আল’ বা ‘আইল’ বা ‘বাধ’ নির্মাণ করার যুক্তি একেবারে অগ্রহণযোগ্য নয়।
প্রাচীন যুগে হিন্দু-বৌদ্ধ শাসনামলে সমগ্র বাংলার ভূভাগ বিভিন্ন জনপদের নামে পরিচিত ছিল। মুসলমানদের আগমনের পর বাংলায় রাজনৈতিক ঐক্য আসে। অবশ্য সেন আমলেই প্রথম সমগ্র বাংলা রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাংলা নামের উৎপত্তির ইতিহাস খুঁজতে হলে সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের কথা বলতেই হবে। বস্তুত ইলিয়াস শাহই (১৩৫২ খ্রি:) সত্যিকার অর্থে ‘বাঙ্গালা’ নাম প্রদানের কৃতিত্বের অধিকারী। একই সাথে একথাও আজ ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, ইলিয়াস শাহই বাংলার তিনটি শাসনকেন্দ্রের (লখনৌতি, সাতগাঁও, সোনারগাঁও) ওপর তার নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন এবং লখনৌতির মুসলিম রাজ্যকে ‘বাঙ্গালার মুসলিম রাজ্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সম্ভবত এরপর থেকেই সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চলের জন্য ‘বাঙ্গালা’ নামটি ব্যবহৃত হতে থাকে।
সমকালীন ভারতের ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফীফ ইলিয়াস শাহকে অভিহিত করেন “শাহ-ই-বাঙালাহ” বা ‘শাহ-ই-বাঙালীয়ান’ আখ্যায়। ইলিয়াস শাহের সেনাবাহিনীকে বলা হয়েছে ‘বাঙ্গালার পাইক’। বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে ‘বাঙ্গালা’ এবং এখানকার অধিবাসীদের ‘বাঙ্গালি’ নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে মুঘলদের আমলে বাংলা পরিচিত হয় ‘সুবা বাঙ্গালা’ হিসেবে। আরো পরে পর্তুগিজ, ইংরেজ এবং অন্যান্য ইউরোপীয়রা বাংলাকে ‘বেঙ্গালা’, ‘বেঙ্গল’ নামে অভিহিত করেছে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলা অঞ্চল সারা পৃথিবীতে ‘বেঙ্গল’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। বাংলা নামের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে এই হচ্ছে ইতিহাস।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।