প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উৎস (ইংরেজি: Three sources of the History of ancient India) ও সেসব উৎসের বিভিন্ন উপাদান হচ্ছে ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের প্রাচীন তিন ধরনের উৎস ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপাদান। ইতিহাসের উৎসের বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, মতবাদ, দেশ-কাল ভেদের বিভিন্নতার জন্যে পৃথক হতে পারে। এর ফলে ইতিহাস বিষয়টির উপর আকর্ষণ অনেক অংশে বেড়ে যায়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের উৎসগুলোকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে (ক) সাহিত্যিক উৎস, (খ) প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস এবং (গ) বিদেশীদের বিবরণ। এই তিন ধরনের উৎস আলোচনার পূর্বে আমরা জেনে নেই ইতিহাসের উৎস কাকে বলে।
যে সকল তথ্য থেকে সত্য আহরণ ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব তা-ই ইতিহাসের তথ্য এবং এই বিভিন্ন ধরনের তথ্যের সমাবেশকে মোটামুটিভাবে ইতিহাসের উৎস বলে বর্ণনা করা যায়। যে সমস্ত উপাদানের দ্বারা তথ্যকে বিশ্লেষণ এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং তার দ্বারা মানবিক জ্ঞানের জগতে নতুন আলোকপাত করা সম্ভব, তাদের ইতিহাসের উৎস বলা হয়। যত প্রাচীন দিকে যাই ততই তথ্যের অপ্রতুলতা লক্ষ্য করা যায় এবং প্রাচীন কাল থেকে যত আধুনিক যুগের দিকে আসি ততই তথ্যের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। এই বক্তব্য পৃথিবীর সব দেশ সম্পর্কেই সত্য বলে মনে করা যায়; কিন্তু তার সময়সীমা বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে বিভিন্ন রকম হতে পারে।[১]
উপযুক্ত উৎসের অভাব প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক-স্বরূপ। একাদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত আরবী পণ্ডিত আল-বিরুনী প্রকাশ্যে হিন্দুদের অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকেরা যেমন এলফিনস্টোন, ফ্লীট, স্মিথ নানা তিক্ত মন্তব্য করেছেন। ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে রমেশচন্দ্র মজুমদার, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী (ক) ভারতীয়দের অদৃষ্টবাদ এবং (খ) হেরোডোটাস, থুকিডাইডিসের মতো ঐতিহাসিকদের অনুপস্থিতিকেই প্রাচীন ভারতীয়দের ইতিহাস বিমুখতার জন্যে দায়ী করেছেন। এই অপবাদগুলিকে স্বীকার করে নিয়েও আমরা অবশ্যই বলতে পারি যে প্রাচীন ভারতের মানুষ ইতিহাস রচনার জন্যে কোন তথ্যই রেখে যাননি—এ ধারণা যথার্থই অমূলক। যে সমস্ত বিষয় তাদের কাছে অর্থবহ ও রক্ষণযোগ্য মনে হয়েছে সেগুলি তারা অবশ্যই সংরক্ষণ করেছেন। প্রাচীন ভারতীয়দের অতীত চর্চার নানা সমালোচনা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে “ইতিহাস” শব্দটিই তারা তৈরি করেছিলেন। “ইতি-হ-আস” (অর্থাৎ অতীতে এমনটিই ঘটেছিল)—ইতিহাস শব্দের এই ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা তারা দিয়েছিলেন। গ্রীক “ইস্তোরিয়া” বা জার্মান “গেশিস্টে”র থেকে “ইতিহাস”-এর ধারণা ভিন্ন ও বোধ হয় ব্যাপকতরও বটে। এক্ষেত্রে তথ্যের অভাবকে সমালোচনা না করে, প্রাপ্ত তথ্যগুলি, তা যতই অপ্রতুল হোক না কেন—তাদের গুণগত মানের সমালোচনা করা দরকার। বস্তুতপক্ষে অপ্রতুল এবং আপাত-অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলিকে বিশ্লেষণের মাধ্যমেই ঐতিহাসিকেরা বহু নতুন দিক নির্ণয় করতে পেরেছেন।
ঐতিহাসিক উৎস সব সময় লিখিত না হতেও পারে। রাজা এবং শাসকদের প্রশাসন পরিচালনা করার জন্যে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের বিভিন্ন উপাদানগুলি—যেমন লেখ ও মুদ্রা, সর্বসাধারণের ব্যবহৃত তৈজসপত্রাদি, ঘর-বাড়ি, মূর্তি ইত্যাদি যা বর্তমানে লুপ্ত হয়ে মাটির তলায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উদ্ধার এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন তথ্যের অনুসন্ধান এবং ব্যাখ্যা সম্ভব। এই বিদ্যা আধুনিককালে একটি স্বতন্ত্র বিদ্যার মর্যাদায় অভিষিক্ত। এই বিষয়টি বর্তমানকালে “প্রত্নতত্ত্ব” নামে চিহ্নিত।
তথ্যসূত্র
১. মল্লিকা ব্যানার্জী ও নূপুর দাশগুপ্ত, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উৎস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, অষ্টাদশ পুনর্মুদ্রণ আগস্ট ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮-৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।