সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল অভ্যুত্থান (ইংরেজি: Santhal rebellion) হচ্ছে আধুনিক বর্বর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী ও স্থানীয় অসভ্য জমিদারদের বিরুদ্ধে মহান সাঁওতাল জনজাতির অভ্যুত্থান। সে সময় ভারতের ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দামিন-ই-কোহ্ বা ‘পাহাড়ের ওড়না’ এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। এই দামিন-ই-কোহ্ অঞ্চল ছিল বিদ্রোহের কেন্দ্রভূমি।
সমাজের প্রভাবশালী সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট আদিবাসী ও উপজাতি হিসেবে পরিচিত বাংলার সংখ্যালঘু জনগণ প্রধানত পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণের সীমান্তে উপ-পার্বত্য (sub-montane) অঞ্চলে বাস করতো। সীমান্তের প্রান্তিক সমাজ হিসেবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো বাঙালিদের থেকে অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো। এমনকি তারা নিজেরাই একে অপর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো। প্রতিটি আদিবাসীর নিজস্ব এলাকা এবং জীবনপ্রণালী ছিল। স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রে প্রতিটি আদিবাসী স্ববিবর্তিত ব্যবস্থা অনুসারে জীবন যাপন করতো এবং তারা কদাচিৎ বহিঃস্থ প্রভাব ও হস্তক্ষেপের প্রভাবাধীন ছিল।[১]
প্রাক-বৃটিশ সকল শাসক এসব আদিবাসীর এলাকাকে মধ্যবর্তী অঞ্চল (buffer states) হিসেবে গণ্য করতো এবং কদাচিৎ তাদের এলাকায় হস্তক্ষেপ করতো। কিন্তু বর্বর অসভ্য ইতর ব্রিটিশ কোম্পানি সরকার এ সকল সীমান্ত-অঞ্চলকে রাজস্বের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে। উপ-পার্বত্য এলাকাসমূহকে কোম্পানি রাষ্ট্রের আওতাধীনে আনা হয় এবং আদিবাসী জনগণকে নগদ অর্থ বা দ্রব্যে রাজস্ব পরিশোধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ ধরনের বিনিময়ের মাধ্যম আদিবাসী জনগণের নিকট অজ্ঞাত বিষয় ছিল।
আদিবাসী সমাজগুলোর নিকট রাষ্ট্রের আইনের বশ্যতা স্বীকার এক অজানা অভিজ্ঞতা ছিল এবং স্পষ্টত তারা এ জাতীয় বশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই যে বর্বর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহের মধ্যে একটা ধনাত্মক সম্পর্ক ছিল। এ বক্তব্যের সপক্ষে অনেক উদাহরণের মধ্যে মাত্র সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক।
সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়কাল
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন গণসমাবেশ আয়োজন প্রক্রিয়ার লড়াকু সৈনিক ছিলেন তাঁদের আপন দুই ভাই চাঁন্দ মূরমূ, ভায়রো মূরমূ এবং বিদ্রোহী-লড়াকু-প্রতিবাদী দুই বোন ফুলো মূরমূ এবং ঝানো মূরমূ। সিধু-কানহু, চান্দ-ভায়রো চার ভাই সাঁওতাল সমাজের ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে আম গাছের ডাল কাঁধে নিয়ে দামিন-ই-কোহ্ এলাকার চারশতাধিক সাঁওতাল গ্রামে গণসমাবেশের প্রচার করেন। ফলে দুর্গম গহীন বনাঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও ৩০ হাজার, মতান্তরে ৫০ হাজারেরও অধিক, সাঁওতাল জমায়েত হয়েছিলেন। সেদিনের ঐতিহাসিক গণসমাবেশে সমবেত জনতার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিধু-কানহু তাঁদের আবাসভূমিকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। সমবেত জনতা রাজ্যের সকল দায়-দায়িত্ব সিধু-কানহু’র ওপর অর্পণ করেন। তাঁরা সকল সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশরাজকে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেন, সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে তাঁরা রাজ্যের সকল দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সাঁওতাল পরগনার ভাগনাডিহি গ্রামের মাঠে এক সভায় সাঁওতাল নেতা সিধু মুরমু ও কানু মুরমুর আহ্বানে আধুনিক বর্বর ইংরেজ সরকার, ব্যবসায়ী, মহাজন, জমিদারদের শাসনশোষণ ব্যবস্থার জায়গায় স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেন দশ হাজার সাঁওতাল। তাঁদের হুল হুল শ্লোগান মুখরিত সেই দিন থেকে পরের ৮ মাস ব্রিটিশ বর্বরদের আক্রমণ করে, জমিদারদের আক্রমণ করে নিজেদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।
তথ্যসূত্র
১. সিরাজুল ইসলাম, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহ”, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।