নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ সাহিত্যের ইতিহাসমনস্ক বিচারের একটি ধারা

নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ (ইংরেজি: New Historicism) হচ্ছে সাহিত্যের ইতিহাসমনস্ক বিচারের একটি ধারা, যদিও ইতিহাসচর্চার সাম্প্রতিক কিছু প্রবণতার সঙ্গে তার নিবিড় যোগ আছে। ১৯৮০ সালে ফ্রান্সের জঁর পত্রিকা রেনেসাঁসের সাহিত্য বিষয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ভূমিকায় স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট জানান যে সংকলনটির প্রবন্ধগুলি এক ‘নিউ হিস্টরিসিজম’ আন্দোলনের সূচনা করেছে। সেই সময় থেকে নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ নামটির প্রচলন হয়।

সে সময় গ্রিনব্ল্যাট ছাড়াও জঁর পত্রিকার সেই সংখ্যাটির বেশ কয়েকজন লেখক ছিলেন মার্কিন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলিতে পড়াতে আসেন মিশেল ফুকো এবং প্রবন্ধকারদের অনেকের উপর তাঁর প্রভাব দেখা গেছে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের প্যারিস অভ্যুত্থানের বিপর্যয়ের পর অনেক ফরাসি বুদ্ধিজীবীর মতো করে মিশেল ফুকো বুঝেছিলেন যে ক্ষমতা মতাদর্শ এবং ভাষায় অন্তর্ব্যাপ্ত, তা বয়ান (ইংরেজি: Discourse) বা ডিসকোর্সের বাইরের কোনো বস্তু নয়। রোলাঁ বার্ত যেমন বলেছিলেন, ভাষা মানেই বিধান, ভাষামাত্রেই শাসন। তেমনি ভাষা, সংস্কৃতি ও ক্ষমতার এই নিগুঢ় ঐক্যের ধারণার মধ্যে ভিয়েতনাম-যুদ্ধের সময়ের ঘটনাবলি থেকে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা পেয়েছিলেন সাহিত্যের সেই সময়ের বহু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্র বুদ্ধিজীবী ।

মিশেল ফুকোর লেখায় প্রধান হিসেবে দেখা দেয় থাকে কোনো একটি ঐতিহাসিক কালের ঐক্যের চাইতে তার অনৈক্য ও অন্তর্দ্বন্দ্ব। এছাড়া ফুকো অনুসারীরা গুরুত্ব দেন প্রতিবাদী আন্দোলনের সম্ভাবনা কীভাবে বয়ানের শাসনে নিয়ন্ত্রিত বা আত্মসাৎ হয় তার উপর। এই দিক বিচারে সত্য আর ইতিহাস হলো ক্ষমতা ও অধিষ্ঠিত জ্ঞানের সমবায়ের একটি প্রতিক্ষেপণ এবং পাঠের (ইংরেজি: Text) মধ্যস্থতা ব্যতীত এই সত্য এবং ইতিহাসের দরজা অধিগম্য নয়। ইতিহাস কেবলমাত্র পাঠ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়—এমন চরম কথা নব্য ঐতিহাসিকতাবাদীরা বলেন না। তবে আমাদের ধরাছোঁয়ার নাগালে যে-ইতিহাস, তার পাঠ্য-চরিত্র সম্পর্কে তারা সতর্ক। পক্ষান্তরে, পাঠকে তারা দেখেন একটি বাস্তব ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিরূপ হিসেবে।

শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার ঐতিহাসিক আলোচনার পুরনো রীতিতে যেমন ভিত্তিতে পাঠ্যবস্তু ও পটভূমিতে ইতিহাস অথবা যুগমানসকে কল্পনা করা হতো, তেমন প্রকল্প এই নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ পরিহার করে। সাহিত্যের পাঠের সঙ্গে অন্য ধরনের পাঠ্যবস্তু যেহেতু এ-ব্যাপারে অভিন্ন, তাই নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ সংক্রান্ত আলোচনায় এই দু-ধরনের পাঠকে প্রায়ই একত্রে অথবা পাশাপাশি পড়া হয়ে থাকে। এই উভয় জাতের পাঠেই শাসন-অন্তর্ঘাত-নিয়ন্ত্রণের বৃত্তটির ক্রিয়া বিদ্যমান, কারণ উভয়টিই একটি সংস্কৃতির ব্যাপকতর প্রতীক ব্যবস্থার শরিক। এই ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের প্রতীক-বিশ্লেষণ প্রণালী প্রয়োগ করেছেন গ্রিনব্ল্যাট ও তাঁর অনুগামীরা। গ্রিনব্ল্যাট তাঁর এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ‘সংস্কৃতির কাব্যতত্ত্ব’।

মিশেল ফুকো ছাড়াও অন্য তাত্ত্বিকদের চিন্তার কমবেশি ব্যবহার করেছেন গ্রিনব্ল্যাট ও তাঁর অনুবর্তীরা। এগুলির মধ্যে আছে গ্রামসির হেজেমনি-তত্ত্ব ও আলথুসারের আইডিওলজি বিষয়ক ব্যাখ্যা, মারকুসের দমনপন্থী সহিষ্ণুতার ধারণা, বাখতিনের প্রতিবাদী ডিসকোর্স-বিশ্লেষণ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সামঞ্জস্য সম্পর্কে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের চিন্তা। প্রবণতার সাদৃশ্য সত্ত্বেও নানা নয়া ঐতিহাসিকতাবাদীর রচনায় তাত্ত্বিক সংহতি অতএব খুঁজে পাওয়া কঠিন।

নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ বিরোধীরা অবশ্য এঁদের লেখায় কয়েকটি মৌলিক প্রসঙ্গে মতৈক্য লক্ষ করেন। রক্ষণশীল উদারপন্থী ও মার্কসবাদীদের সঙ্গে এই ধারার বিবাদ তো রয়েছেই—কিন্তু একদা নয়া ঐতিহাসিকতাবাদীদের সহযাত্রী, রেমন্ড উইলিয়ামসের অনুগামী ব্রিটেনের সাংস্কৃতিক বস্তুবাদীরাও গ্রিনব্ল্যাট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নানা আপত্তি তুলেছেন। তাদের আশঙ্কা যে মার্কিন বিনির্মাণবাদীদের মতো গ্রিনব্ল্যাট-শিবিরও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের দায় থেকে পিছু হটেছেন। তার বদলে গুরুত্ব পাচ্ছে প্রায় স্বশাসিত একটি সংস্কৃতির বা প্রতীক-ব্যবস্থার বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণেও বেশি জায়গা জুড়ে আছে রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিরূপায়ণের বিচার। বিজ্ঞাপন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এক প্রায় পরাবাস্তব সমাজে মাইমেটিক ক্যাপিটালের সংবাহনের প্রক্রিয়ার প্রতি মনোযোগ স্বাভাবিক, বিশেষত এই প্রক্রিয়া যখন আধিপত্যের মুখ্য হাতিয়ার। কিন্তু এই অতি-মনোযোগের ফলে প্রতিরূপ নির্মাণের বাস্তব ইতিহাস হয়ত উপেক্ষিত হচ্ছে। 

সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ পাঠ্যবস্তুকে, বিশেষ করে দফতরখানার সরকারি বৃত্তান্তের বাইরে অবস্থিত সাহিত্যকে, এক নিরন্তর সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে দেখে। বয়ান বা ডিসকোর্স এই সংঘর্ষের মাধ্যমে বদলায় এবং পাঠ্যবস্তুর ব্যাখ্যারও তাই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় না। লেখকের প্রতিরোধী ভূমিকার পরিসর অনেক কমে যায় শাসন-বিচ্যুতি-নিয়ন্ত্রণের প্রায় ছেদহীন বৃত্তের ভেতর। জনাথন ডলিমোর, অ্যালান সিনফিল্ডসহ আরো অনেক সাংস্কৃতিক বস্তুবাদীরা আগের যুগের পাঠ্যবস্তু বর্তমানে যে রাজনৈতিক মতাদর্শগত প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে তাকে প্রশ্ন করবার ধারাটিকে সামাজিক দায়িত্ব বলে মনে করে থাকেন।

আবার দেখা যায়, পেশাদার ঐতিহাসিকরা বলেন যে নয়া ঐতিহাসিকতাবাদীরা প্রায় সময়েই সাক্ষ্যবিচারে পক্ষপাত দেখান, ছোট ছোট বৃত্তান্ত বা অ্যানেকডোটের উপর বেশি নির্ভর করেন, ঘটনার অনুপুঙ্খ খুঁজে নেন অতীত ঐতিহাসিকদের পুরনো গবেষণা থেকে। সংঘর্ষ ও দমনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার এবং তার বিরোধীদের ছোটোখাটো আপোস রফা তাদের নজর এড়িয়ে যায়। নয়া ঐতিহাসিকতাবাদ রেনেসাঁসের প্রতিষ্ঠিত পুরুষ লেখকের বাইরে তাকাতে নারাজ, এমন অভিযোগ করেছেন কিছু নারীবাদী সমালোচক। সেরা নয়া ঐতিহাসিকতাবাদী কাজে আজকাল এইসব অভিযোগের মোকাবিলার চেষ্টা চোখে পড়ে।

তথ্যসূত্র

১. স্বপন চক্রবর্তী, “নিউ হিস্টরিসিজম”, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, নবযুগ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০১০; পৃষ্ঠা ৩৫১-৩৫২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!