আধুনিক নৃত্য বা আধুনিকবাদী নৃত্য (ইংরেজি: Modern Dance) হচ্ছে পশ্চিমা সংগীতানুষ্ঠান বা নাট্য নৃত্যের একটি বিস্তৃত ঘরানা, মূলত উনিশ এবং বিশ শতকের শুরুতে জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি উদয় শঙ্কর এবং রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে ভারতে জনপ্রিয় হয়। ভারতীয় শাখাটিকে অনেক সময় সৃজনশীল নৃত্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ধ্রুপদী ও লোকধারার নৃত্যের বাইরের এই ধারাটি একধরনের নৃত্যের যা ১৯৮০-এর পরে জনপ্রিয় হয়েছে। এ নৃত্য যোগ্য স্রষ্টার বিনির্মাণে নতুনতর মাত্রায় সংযোজিত হয়।
বিভিন্ন আঙ্গিকের নৃত্যরীতিকে ভেঙ্গে তৈরি করা এই নৃত্যের প্রথম রূপকার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরে বহু বর্ণবিভঙ্গে উদয়শঙ্কর। বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সংগীত, নৃত্য ও চারু ও কারুশিল্পের যে একটি বিশেষ স্থান থাকা দরকার রবীন্দ্রনাথ শুধু তা অনুভবই করেননি, প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শান্তিনিকেতনে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে তার একটা সম্মানজনক স্থান দিয়ে সমাজে তার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিয়েছেন। একে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি যথেষ্ট কায়িক ও মানসিক পরিশ্রমও করেছেন। নিজে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নেচেছেন, নাচে উৎসাহ দিয়েছেন, নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন, নৃত্যনাট্যের রস আস্বাদন করেছেন, সেসবের মহড়া ও পরিচালনা করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘আমি বিচিত্রের দূত। নাচি, নাচাই, হাসি, হাসাই, গান করি, ছবি আঁকি, যে আবিঃ বিশ্বপ্রকাশের অহেতুক আনন্দে অধীর আমরা তারই দূত।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে নৃত্যকলা মর্যাদা পেয়েছিল দেহের চলমান একটি শিল্পরূপে। এই ছন্দের আনন্দেই তিনি নিঃসঙ্কোচে শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন নাচের একটি প্রাণবান আন্দোলন। পূর্বদেশের বিভিন্ন জায়গার পরিভ্রমণে তিনি নানা রীতির নৃত্যকলা, দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। জাভা, বালি, শ্যাম, চীন ও জাপান ছাড়াও ভারতের কোচিন, মালাবার ও মণিপুরে তিনি যেমন নাচ দেখেছেন তেমনি ইউরোপের লোকনৃত্য ও অন্যান্য রীতির নাচ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর নিজের কথায় ‘…এই কথা আপনাদের বলতে দ্বিধা করব না যে আমাদের আশ্রমে নৃত্যকলার ভিতরে সকল ধারা মিলেছে, তার পিছনে যে সাধনা, যে শিল্পবোধ রয়েছে এবং সমগ্রের সৌন্দর্যবিকাশ আছে তা যে কোনোখানেই দুর্লভ।’ এ থেকে বোঝা যায় তিনি নৃত্যকলাকে একটি সম্মানজনক বিদ্যারূপে অনুভব করেছিলেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে নৃত্যকলার প্রবল অভাব দেখা দিয়েছিল নগরবাসী শিক্ষিতসমাজে। তখন নৃত্যকলা ছিল বিলাস বা প্রমোদ উপকরণসামগ্রী । ক্রমে এর চর্চা নিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল পেশাদার বাইজি, খেমটাওয়ালি বা যাত্রা-থিয়েটারের নর্তক-নর্তকীদের মধ্যে। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ যে নৃত্য আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন তারই পরিণতি আমরা লক্ষ করি তাঁরই রচিত অসামান্য নৃত্যনাট্যগুলিতে।
বিভিন্ন ধ্রুপদী ও লোকনৃত্যের এক অসাধারণ মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি যার জন্ম দিলেন, তাকেই বলা যায় সৃজনশীল নৃত্য। তিরিশ দশকের গোড়ায় শ্রীমতী ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের ‘ঝুলন’ কবিতাটির আবৃত্তির সঙ্গে একটি নৃত্য পরিবেশন করেন। এর আগে তিনি মেরি ওয়িগম্যান, কাটস, ও রুডলফ লাবান যারা ইউরোপের নৃত্যজগতে বৈপ্লবিক আলোড়ন এনেছিলেন, এদের কাছে শিক্ষালাভ করেন। তার নাচ দেখে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়ে বলেছিলেন এই তার নিজস্ব নাচ।
এই নিজস্ব নাচের বহুমাত্রিকতা দেখা দেয় পরবর্তীকালে উদয়শঙ্করে মধ্যে বিপুলভাবে। লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ আর্টসে চিত্রকলা শিক্ষা সম্পন্ন করে ওই কলেজেরই অধ্যক্ষ রোদেনস্টাইনের মাধ্যমে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার অনুরোধে ভারতীয় বিষয়ে দুটি নৃত্য ‘হিন্দুবিবাহ’ ও ‘রাধাকৃষ্ণ’ রচনা করেন এবং সহ নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি আনা পাভলোভার সঙ্গে নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। নৃত্যে কোনো প্রথাগত শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের মতো তার মধ্যেও ছিল নৃত্যসৃজনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভা। লন্ডনের অপেরা হাউসে, কভেন্ট গার্ডেন ও বিভিন্ন অভিজাত প্রেক্ষাগৃহে তিনি নিয়মিত নৃত্যপ্রদর্শন করতে থাকেন। আনা পাভলোভাই তাকে পশ্চিমি নৃত্য অনুসরণ না করে প্রাচ্যের শিল্পকলা তথা নৃত্যধারা অনুসরণে অনুপ্রাণিত করেন। এছাড়া সুইডিস শিল্পী এলিস বোনারও তাকে ভারতীয় নৃত্য ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে সাহায্য করেন। তাঁর সঙ্গেই উদয়শঙ্কর ভারতের কাশ্মীর থেকে মালাবার হিল্স পর্যন্ত ভ্রমণ করে নিজ দেশের মানুষের জীবনধারা ও নৃত্যকলার সঙ্গে পরিচিত হন। ত্রিশের দশকে মিস এলিস বোনারই তাকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে নৃত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে দেন। এর আগে ১৯২২ সালে লন্ডনের জেমস পার্কে অনুষ্ঠিত একটি সাহায্য রজনীতে সম্রাট সন্ত্রাসী পঞ্চম জর্জ উদয়শঙ্করের অসি নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন এবং ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানান।[১]
ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যরীতিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ভেঙে চুরে নতুনভাবে উপস্থাপিত করেন উদয়শঙ্কর। গুরু শঙ্করন নাম্বুদ্রি তার অনুরোধে কথাকলি আঙ্গিকে কার্তিকেয় নৃত্য রচনা করে দেন যা উদয়শঙ্করের উপস্থাপনায় এক ঐতিহাসিক মর্যাদা পায়। ১৯৩১-৩৩ সালে তিনি তাঁর সম্প্রদায় নিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় তাঁর সৃজিত আধুনিক নৃত্য কলা প্রদর্শন করেন। তার সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলেন ফরাসি নৃত্যশিল্প সিমকি, ছোটোভাই রবিশঙ্কর, বোন কনকলতা, কাকা ভবানীশঙ্কর ও আত্মীয় রাজেন্দ্রশঙ্কর। এছাড়া নেপথ্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন তিমিরবরণ, শচীন দেববর্মণ, কৃষ্ণচন্দ্র দে, আলাউদ্দিন খাঁ, আলি আকবর খাঁ প্রমুখ। এ সময়কার বিখ্যাত নাচগুলির মধ্যে অসিনৃত্য, কার্তিকেয় নৃত্য, নটরাজ, হরপার্বতী উল্লেখযোগ্য।
১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে উদয়শঙ্কর তার সম্প্রদায় নিয়ে ইন্দ্রনৃত্য ইত্যাদি প্রদর্শন করে তিনি কবির আশীর্বাদধন্য হন। ১৯৩৯ সালে তিনি আলমোড়াতে উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টার স্থাপন করেন। সেখানে নিয়মিত সৃজনশীল নৃত্যের অনুশীলন হত। এখানেই তার বিখ্যাত সৃষ্টি ‘রিদম অফ লাইফ’, ‘লেবার অ্যান্ড মেশিনারি’ সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় রামায়ণ অবলম্বনে ছায়ানাট্য ‘রামলীলা’। ১৯৪৭ সালে তিনি নির্মাণ করেন তার অসাধারণ চলচ্চিত্র ‘কল্পনা’ যার প্রধান উপজীব্য ভারতীয় আধুনিক নৃত্য কলা। ব্রাসেলস-এ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এটি শ্রেষ্ঠ কাহিনি চিত্রের স্বীকৃতি ও সম্মান পায়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি প্রযোজনা করেন ‘সামান্য ক্ষতি’ এবং ১৯৬৬ সালে চণ্ডালিকা অবলম্বনে ‘প্রকৃতি ও আনন্দ’। ১৯৬৮ সালে তিনি শেষবার দু’মাসের জন্য কানাডা ও আমেরিকা সফর করেন তাঁর সম্প্রদায় নিয়ে। ১৯৬১-৭০ তিনি তাঁর নতুন সৃষ্টির স্বাক্ষর রাখেন চলচ্চিত্র, মঞ্চভিনয় ও নৃত্য মিলিয়ে শঙ্করস্কোপ-এ।
উদয়শঙ্করের স্ত্রী অমলাশঙ্কর ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’ নামে একটি সৃজনশীল নৃত্যের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন যা আজও টিকে আছে। তাঁদের সুযোগ্য কন্যা মমতাশঙ্কর ও পুত্রবধূ তনুশ্রী শঙ্করও নৃত্য নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়াস পেয়েছেন। এছাড়া শম্ভু ভট্টাচার্য, বুলবুল চৌধুরী, অচ্যুতনারায়ণ, শচীনশঙ্কর, অনাদিপ্রসাদ, শান্তি বসু, বটু পাল, অসিত চট্টোপাধ্যায়, গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার, রেখা মৈত্র, অলকানন্দা রায়, সাধন গুহ, পলি গুহ, রঞ্জাবতী সরকার প্রমুখ আধুনিক নৃত্য শিল্পীরা নিজের ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। রবীন্দ্র নৃত্যধারায় মৌলিক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে শান্তিদেব ঘোষের নাম অবিস্মরণীয়।
তথ্যসূত্র
১. সুশীল সাহা, “সৃজনশীল নৃত্য”, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, নবযুগ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০১০; পৃষ্ঠা ৬৫৮-৬৬০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।