পাবনা কৃষক বিদ্রোহ ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ

পাবনা কৃষক বিদ্রোহ (ইংরেজি: Pabna Peasant Uprising) ছিল ১৮৭৩ সালে জমিদারদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহনীল বিদ্রোহের পর দুই দশক ধরে অব্যাহত শান্তি বিরাজ করে। কৃষক সমাজ তাদের নিজস্ব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সুখে বাস করছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ১৮৭০ এবং ৮০-এর দশকে প্রজাগণ পুনরায় প্রতিরোধমুখী হয়ে উঠে। ১৮৬০-এর দশকে কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং ভূমির উপর বাড়তি জনসংখ্যার চাপের ফলে ভূমালিকরা (landowners) খাজনার হার বৃদ্ধিতে তৎপর হয়। কিন্তু রায়তগণ পরগনা নিরিখ অনুযায়ী খাজনা প্রদানে তাদের রীতিসিদ্ধ অধিকারের উপর জোর দেয়। ১৮৭০ থেকে দুই দশকের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে কৃষক বিদ্রোহ লক্ষ্য করা যায় সুন্দরবনের তুষখালিতে (১৮৭২-৭৫), নোয়াখালীর ছাগলনাইয়ায় (১৮৭৪), উপ-পার্বত্য ময়মনসিংহে (১৮৭৪-৮২), ঢাকার মুন্সিগঞ্জে (১৮৮০-৮১) এবং মেহেদীগঞ্জে (১৮৮০-৮১)।[১]

সবচেয়ে প্রচণ্ড কিন্তু ব্যাপকভাবে অহিংস ও সুসংগঠিত ছিল ১৮৭৩ সালের পাবনা কৃষক বিদ্রোহ। পাবনার জমিদারগণ, যারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রাক্কালে নিলাম ক্রেতা হিসেবে ভূমি নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন, তারা প্রায় সকলেই ছিলেন অনাবাসিক (non-resident)। সময়ে সময়ে খাজনা বৃদ্ধি করা ছাড়াও ভূমালিকরা সকল ধরনের আবওয়াব (abwab) সংগ্রহ করতেন। যখন অহরহ খাজনা বৃদ্ধি ও অবৈধ আবওয়াব সংগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য আবেদনে কাজ হলো না, তখন ক্ষুব্ধ প্রজারা ১৮৭৩ সালে খোলাখুলিভাবে অমান্য আন্দোলন শুরু করে। অমান্য আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রথমে সিরাজগঞ্জে শুরু হয়। শীঘ্রই তা অন্যান্য পরগনা ও জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

রায়ত বা প্রজাগণ নিজেদেরকে সুস্পষ্ট নেতৃত্বের অধীনে বিভিন্ন জোট ও লীগে সংগঠিত করে।[২] আইনসম্মত যুদ্ধ করা ও সার্বক্ষণিক লাঠিয়াল বাহিনী পরিচালনার জন্য সংগঠকগণ সমগ্র কৃষক সম্প্রদায়ের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তারা নিজেদের দাবির ব্যাপারে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা চালায়। এক গ্রামে সফল হলে তারা অন্য গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এভাবে প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণের ফলে সমগ্র জেলা কৃষক লীগসমূহের সমর্থকে পরিণত হয়। প্রথম দিকে নেতৃত্ব প্রদান করেন দৌলতপুরের এক ক্ষুদে ভূস্বামী ঈশ্বর চন্দ্র রায়। শীঘ্রই জগতুলার খুদি মোল্লা নামে এক মুসলমান জোতদার জোটগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি কৃষকদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হন। পরবর্তীতে আরেকজন কৃষকনেতা খ্যাতি লাভ করেন। তিনি হলেন ষোলঘরের চন্দ্রনাথ মজুমদার।

পাবনা কৃষক বিদ্রোহ ছিল প্রকৃতপক্ষে অনাবাসিক জমিদারদের সাথে সাধারণ কৃষক সমর্থিত স্থানীয় ক্ষুদে ভূমালিকদের বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। খাজনা প্রদান বন্ধ রাখা হয় যতক্ষণ না বৃহৎ অনাবাসিক জমিদারগণ কৃষকদের এ দাবি মেনে নেন যে ভূমির উপর তাদের অধিকার রয়েছে এবং বিনা কারণে ভূমালিকদের খাজনা বৃদ্ধির কোনো অধিকার নেই। এ ধারণা কৃষকদের মধ্যে সাধারণভাবে বিরাজ করছিল এবং এ ধারণা পোষণে তারা কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হয় নি, বরং রীতিসিদ্ধ অধিকারের ব্যাপারে তাদের সচেতনতাই এর মূলে ক্রিয়াশীল ছিল। গ্রামাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ১৮৮৫ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সংবিধানে ঈষৎ পরিবর্তন করে ১৮৮৫ সালে এক নতুন প্রজাস্বত্ব আইন প্রণীত হয়। এভাবে ১৮৮৫ সালের বাংলা প্রজাস্বত্ব আইন কেবল অনেকের কল্পিত কোনো উদারপন্থী তত্ত্ব নয়, বরং তার চেয়ে অধিক পরিমাণে কৃষক বিদ্রোহের ফলশ্রুতি ছিল। 

তথ্যসূত্র

১. সিরাজুল ইসলাম, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহ”, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩।
২. কে. কে. সেনগুপ্ত তার পুস্তক ও প্রবন্ধে কৃষকদের সাংগঠনিক কাঠামো অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। দেখুন, তার রচিত গ্রন্থ Pabna Disturbances and the Politics of Rent 1873-1885 (New Delhi 1974); SIC 736, “Agrarian League of Pabna”, Economic and Social History Review, 7:2 (1970), 253-69.

Leave a Comment

error: Content is protected !!