অনুশীলন সমিতি (ইংরেজি: Anushilan Samiti) ব্যায়ামচর্চা, চরিত্রগঠন, সমাজসেবা ও দেশাত্মবোধক নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ কলকাতার হেদুয়া অঞ্চলে সতীশচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। উপনিবেশবাদ বিরোধী সশস্ত্র লড়াই এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে যে চারটি দল তাদের ভেতর অনুশীলন ও যুগান্তর দল ছিলো প্রধান সারিতে। পরে এসেছে কমিউনিস্ট পার্টি এবং ফরোয়ার্ড ব্লক।
অনুশীলন ও যুগান্তর দুটো দলই ছিল কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ বিরোধী। আর ঐ দল দুটি কংগ্রেস মুসলিম লিগের মতো ব্রিটিশদের দালালিও করেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অনুশীলন ও যুগান্তর দলকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। পরে কমিউনিস্ট পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে রাখে। ভারত মুক্তির ইতিহাসে হাজারে হাজারে প্রাণ দিয়েছেন অনুশীলন ও যুগান্তর দলের সদস্যরা। মূলত স্বাধীনতার শত্রু মুসলিম লিগ বা কংগ্রেসের উত্তরাধিকারীরা এইসব কথা বলে থাকে যে, তারা খারাপ, কারণ অনুশীলন ও যুগান্তর দলের অনেক সদস্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। আবার অনুশীলন ও যুগান্তর নিষিদ্ধ ছিল, ফলে ঐ দুই দলের কিছু লোক প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন কংগ্রেসে থেকেও কাজ করেছেন সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীনতা অর্জনের।[১]
অনুশীলন সমিতি ও প্রাসঙ্গিক ইতিহাস
১৯০২ সালে সমিতির সভাপতি ছিলেন প্রমথনাথ মিত্র এবং সম্পাদক হন সতীশচন্দ্র বসু। সমিতি প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর এর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৯ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে যার বর্তমান নাম বিধান সরণি।[২]
১৯০৩ সালে বাংলাদেশে গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন স্থাপনের জন্য বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষ কর্তৃক প্রেরিত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (নিরালম্ব স্বামী) অনুশীলন সমিতির সহযোগে একটি গুপ্ত বিপ্লবী আখড়া স্থাপন করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বরোদা থেকে এসে তার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
শরীরচর্চার উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠলেও সমিতি ক্রমে বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয়। বরোদা গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাবার পর প্রমথনাথ মিত্রর সভাপতিত্বে অরবিন্দ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, সরলা দেবী, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভগিনী নিবেদিতাকে নিয়ে সমিতির অভ্যন্তরীণ গোপন চক্র গঠিত হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রমথনাথ ঢাকা সমিতির পত্তন করেন ও যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুলিনবিহারী দাস। সমিতির ঢাকা কেন্দ্রের অধীনে পাঁচশো শাখা গঠিত হয়; এবং তার কর্মক্ষেত্র ক্রমে পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, অসম, উড়িষ্যা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, বোম্বাই প্রভৃতি প্রদেশে প্রসারিত হয়। বাংলার খ্যাতনামা প্রায় সমস্ত বিপ্লবীই একদা এই সমিতির সদস্য ছিলেন।
প্রমথনাথ ও নিরালম্ব স্বামীর সঙ্গে বিপ্লবের কর্মকৌশল নিয়ে মতভেদ হওয়ায় বারীন্দ্রকুমার বন্দেমাতরম পত্রিকায় একটি বিবৃতি দিয়ে পৃথক হয়ে যান এবং মানিকতলা মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির এক গুপ্ত কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগো, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখ কর্মী। অরবিন্দ ছিলেন দলপতি। বোমা তৈরির সঙ্গে গোপনে পিস্তল সংগ্রহের কাজও চলে। অরবিন্দ-বারীন্দ্র চক্রের সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী (বাঘা যতীন), অমরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (মানবেন্দ্রনাথ রায়) প্রমুখ বিপ্লবী যুক্ত হন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে বারীন্দ্রের পরিচালনায় ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যুগান্তর নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়। স্বভাবতই তার উপর সরকারের কোপদৃষ্টি পড়ে। বস্তুত এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সমিতির ভিতরে যুগান্তর দল নামে পৃথক একটি বিপ্লবপন্থী উপদল সৃষ্ট হয়। কালক্রমে মূল দলের সঙ্গে যুগান্তর দলের বিরোধ ও রেষারেষি দেখা দেয়।
বিপ্লববাদী ক্রিয়াকলাপের অভিযোগে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সমিতির মুরারিপুকুর গোষ্ঠীর সদস্য ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। অরবিন্দ ও নিরালম্ব স্বামী গ্রেপ্তার হন। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯০৮-১০) বারীন্দ্র ও তাঁর সহযোগীরা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত হন। অরবিন্দ ও নিরালম্ব স্বামী মুক্তি পান। ব্রিটিশ সরকার ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সমিতিকে ও বিভিন্ন জেলায় সহযোগী অন্যান্য বিপ্লবী সংগঠনকে বেআইনি ঘোষণা করেন। সমিতির গোপন ক্রিয়াকলাপ অবশ্য অব্যাহত থাকে এবং ক্রমে গুপ্তহত্যা ও ডাকাতির পথে চলতে থাকে।
অনুশীলন সমিতি তার দীর্ঘকালের ঘটনাবহুল গতিপথে বহু শাখাপ্রশাখা গড়ে ওঠে এবং বহির্বিশ্বেও সমিতির কর্মপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে। দেশের স্বাধীনতার আদর্শে নানা ধরনের অ্যাকশন কর্মসূচিতে একক অথবা যৌথভাবে বহুজনেই নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেন। প্রথম বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময়ে জার্মান অস্ত্রের সাহায্যে দেশে সশস্ত্র অভূত্থানের প্রয়াস নিস্ফল হয়। কর্মীদের অনেকেই নিহত কিংবা কারারুদ্ধ হন। আবার অনেকে বিদেশে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করেন।
মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসনসংস্কার সূত্রে ১৯২০ সালে রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্তি পান। অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে কোনও রকম হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপে তাঁরা আর লিপ্ত হবেন না এই মর্মে বিপ্লবীরা ধুরন্ধর শয়তান মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে প্রতিশ্রুতি দেন। যুগান্তর ও অনুশীলন দলের অনেক নেতা কংগ্রেসের এবং স্বরাজ্য দলের সঙ্গে যুক্ত হন। কুড়ির দশকের শেষ দিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে অনুশীলন দল যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর সমর্থনে এবং যুগান্তর দল সুভাষচন্দ্র বসুর সমর্থনে দুটি বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
উভয় দলের কিছু কিছু তরুণ বিপ্লবী হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের ক্রিয়াকলাপে উদ্যোগী হন। উত্তর ভারতে বিপ্লবী প্রচেষ্টা মাথাচাড়া দেয়। বাংলার চট্টগ্রামে সূর্যসেনের নেতৃত্বে এবং মেদিনীপুর প্রভৃতি স্থানে বিপ্লবীদের সঙ্গে সরকারের সংঘর্ষ বাধে। সরকারের দমননীতিও প্রবল হয়ে ওঠে। ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বিপ্লবীরা জেল থেকে ছাড়া পান। তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন বামপন্থী দলে যোগদান করেন। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে যুগান্তর দল একটি বিবৃতির মাধ্যমে ভেঙে দেওয়া হয়।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ১৯ অক্টোবর ২০১৮, “অনুশীলন সমিতি ছিল বাংলার বিপ্লববাদী উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল : https://www.roddure.com/bangladesh/anushilan-samiti/
২. চিন্মোহন সেহানবীশ গণেশ ঘোষ ও অন্যান্য, মুক্তির সংগ্রামে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা দ্বিতীয় সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১০ পৃষ্ঠা ৫৬
৩. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৬-১৭।
রচনাকাল ১৯ অক্টোবর ২০১৮, নেত্রকোনা।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।