সাহিত্য বা সাহিত্যের স্বরূপ (ইংরেজি: Nature of Literature) হলো একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, উপ-সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন বা এই জাতীয় লিখিত রচনার লিখিত রূপ যা কবিতায় বা গদ্যে উপস্থিত হতে পারে। পাশ্চাত্যে সাহিত্যের সূত্রটি সুমেরীয় অঞ্চলের দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার উরুক শহরে (আনু. ৩২০০ খ্রি পূ) উদ্ভূত হয়েছিল এবং মিশরে বিকাশ লাভ করেছিল, পরে গ্রীসে (ফিনিশিয়ানদের কাছ থেকে লিখিত শব্দ এখানে আমদানি করা হয়েছিল) এবং সেখান থেকে রোমে প্রকাশিত হয়েছিল । মনে হয় লেখালেখির উদ্ভাবন স্বাধীনভাবে ভবিষ্যৎ বাণী থেকে চীনে মেসোমেরিকা এবং অন্য কোথাও স্বাধীনভাবে হয়েছিল।[১]
মানুষের জীবনযাপনের রূপ ও প্রকৃতি বিচিত্র। সভ্যতার আদিকাল থেকে এই বিচিত্র-রূপী জীবন উপভোগের জন্য মানুষ কেবল বস্তুগত উপাদানের ওপরই নির্ভর করেনি। সৃষ্টি করেছে অনুভূতি প্রকাশের বিচিত্র আঙ্গিক। আদি মানব পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদানের জন্য প্রথম যে ধ্বনিটি উচ্চারণ করেছিলো, তাই সভ্যতার আদি শিল্প। ধ্বনি>শব্দ> ভাষা এই বিবর্তন পরম্পরার মধ্য দিয়ে সঙ্গীত সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পরূপের জন্ম হয়েছে।
সভ্যতার একেকটি পর্যায়ে একেকটি সাহিত্য রূপের (Literary Form) জন্ম হয়েছে। মানুষের জীবনযাপনের প্রকৃতি, ভাব ও ভাবনা, চিন্তা প্রকাশক্ষমতার বৈশিষ্ট্যই বিভিন্ন যুগে সাহিত্যের রূপ ও শাখাগুলোর জন্ম দিয়েছে। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রধান কয়েকটি আঙ্গিক । বিষয়ভাবনা ও বিন্যাসের দিক থেকে প্রতিটি সাহিত্যরূপই স্বতন্ত্র।
সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে একটি নির্বস্তুক ধারণা। বস্তুর স্বভাব ও প্রকৃতি দিয়ে এর বিচার সম্ভব নয়। আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি যে সকল ধারণা আমরা সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি এর কোনোটাই বস্তুস্বভাবকে প্রকাশ করে না। কিন্তু মানুষের বাস্তব জীবনই সাহিত্য সৃষ্টির উৎস। সাহিত্যের স্বরূপ ও শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে এ-কথাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। ব্যক্তিমানুষ যেমন আপনা আপনি সৃষ্টি হয় না, তেমনি মানুষের সৃষ্ট সাহিত্য শূন্য থেকে আবির্ভূত হয় না।
সাহিত্য-শিল্প যে জীবন থেকে উদ্ভূত—এই ধারণা প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। গ্রীক দার্শনিক ও তাত্ত্বিক প্লেটো (খ্রি. পূ. ৩য়-৪র্থ শতক) তাঁর Republic গ্রন্থে শিল্প-সাহিত্যসৃষ্টির বেশ কয়েকটি সূত্র নির্দেশ করেছেন:
১. শিল্পসৃষ্টি হলো অনুকরণ। মানুষের অভিজ্ঞতার জগই শিল্পসাহিত্যের অবলম্বন। তিনি মনে করতেন কবির সৃষ্টি অনুকরণের অনুকরণ এবং তা মিথ্যা।
২. শিল্পের সঙ্গে নীতির সম্পর্ক সুগভীর। শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব নৈতিক গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল।
৩. সাহিত্যশিল্প ভাবের বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়।
৪. দর্শনের সত্য শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। এই ধারণার ফলে সাহিত্যের সত্য ও দর্শনের সত্যের মধ্যে তিনি কোনো পার্থক্য নির্দেশ করতে পারেন নি।
৫. কাব্যে রূপের চেয়ে ভাবই বেশি গুরত্বপূর্ণ।
এই সূত্রগুলো থেকে বোঝা যায় প্লেটো অনুকরণ বলতে অবিকল প্রতিরূপ বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটল (খ্রি.পূ. ৪র্থ শতক) অনুকরণের বিশেষ লক্ষণ হিসেবে অনুকরণকে প্রাধান্য দিলেন। তাঁর মতে শিল্প এবং সাহিত্যের পার্থক্যের মাধ্যম হলো ভাষা। তিনি অনুকরণ শব্দটিকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যাপক অর্থে। তাঁর মতে সাহিত্য জীবনের অনুকরণ — যে জীবনে ঘটনা, অনুভূতি, চিন্তা, কর্ম, বাস্তব অপেক্ষা সত্য হয়ে ধরা দেয়। এই অনুকরণ-তত্ত্বটি দীর্ঘকাল সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে একটি প্রধান মানদণ্ড হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ ছিলো ভাষাহীন, নিঃশব্দ। তখন মানুষের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিলো বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি। পরিবারভুক্ত, যূথবদ্ধ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজনেই সৃষ্টি করে ভাষা। সেই প্রয়োজন ছিলো একানভাবেই বস্তুগত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে মানুষের চিন্তা, কর্ম ও অনুভূতির বহুমুখী বিস্তার ঘটে। মানুষের সম্পর্ক যেমন স্থূল, বস্তুসর্বস্ব থাকে না, তেমনি তার জীবনযাপন ও জীবন উপভোগের ক্ষেত্রেও সংবেদনশীলতা ও সূক্ষ্মতার প্রকাশ ঘটতে থাকে। আদি মানব তার ভাব প্রথম প্রকাশ করে চিত্রের মাধ্যমে – প্রাচীন গুহাগাত্রে এখনও তার নিদর্শন বিদ্যমান। ভাষা আবিষ্কার হবার পর মানুষ ক্রমান্বয়ে তার বিচিত্র ভাবকে আঙ্গিকের আশ্রয়ে প্রকাশ করতে থাকে। এভাবেই মানুষের আদি শব্দশিল্প কবিতার সৃষ্টি। নাটকের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন উপযোগী শিল্পমাধ্যম তৈরির প্রয়োজনবোধ থেকে। সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় এভাবেই মানুষ ক্রমান্বয়ে তার জীবনযাপন, জীবন উপভোগ ও তার সূক্ষ্মতর প্রকাশের প্রয়োজনে বিভিন্ন সাহিত্য আঙ্গিকের সৃষ্টি করেছে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে মানুষ তার প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠক্রমে সাহিত্যের উলিখিত শাখাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই শাখা বা শ্রেণির স্বরূপ অনুধাবনের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই কিছু প্রাথমিক মৌলিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ-প্রসঙ্গে প্রথমেই আসবে শ্রেণি বিভাজনের প্রশ্ন। আবার শ্রেণি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিভিন্ন রূপে বিভক্ত সাহিত্যরূপ বা ফর্ম (যেমন, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ) বুঝতে হলে তার ভাব বা বিষয়বস্তু (Content) এবং গঠনকৌশল (Structure) সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এ-প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখেই আমরা সাহিত্যের ‘স্বরূপ ও শ্রেণীবিভাগ’ পর্ব পাঠ্যসূচির শুরুতে অন্তর্ভুক্ত করেছি এবং ক্রমানুসারে সেগুলো উপস্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি:
উদ্দেশ্য, উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রাথমিক প্রয়োজনীয় ধারণা লাভ এবং সাহিত্যের স্বরূপ, রস ও বিভিন্ন শাখাগুলোকে বিচার করার দক্ষতা অর্জন। একজন স্বাবলম্বী শিক্ষার্থী হয়ে উঠতে সকলেরই যা কাম্য।
তথ্যসূত্র
১. Joshua J. Mark, “Literature” Ancient History Encyclopedia, সংগ্রহের তারিখ: ৫ জানুয়ারি ২০২০, Ancient History Encyclopedia Foundation, হাইপারলিংক: https://www.ancient.eu/literature/.
রচনাকাল: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ময়মনসিংহ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।