বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বা বাঙালির সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলন বা বাংলার বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (ইংরেজি: Revolutionary movement for the independence of Bengal) হচ্ছে বাঙালি বিপ্লবীদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বহুবিধ কার্যকলাপের প্রধান অধ্যায়। এই আন্দোলন গোপন ও প্রকাশ্য বিপ্লবী দলগুলির ক্রিয়াকলাপের একটি অংশ ছিল।
ভারতের স্বাধীনতার শত্রু মুৎসুদ্দি প্রতিনিধি সাম্প্রদায়িক সামন্তবাদী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত সাধারণভাবে আইন অমান্য আন্দোলনের বিরোধী পক্ষ হিসাবে সেসময়ের ক্ষমতাসীন আধুনিক বর্বর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী বাংলার বিভিন্ন গোষ্ঠী এই সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করে। বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলি মূলত বাংলা প্রদেশের কলকাতা, মেদনিপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহে কেন্দ্রীভূত ছিল। বিশ শতকের আগেই এটি শুরু হয় এবং বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এটি চালু থাকে।[১]
বিপ্লবী সমিতিগুলির কার্যকলাপ
মূল নিবন্ধ: অনুশীলন সমিতি
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাতেও নানা বিপ্লবী সংগঠন তৈরী হয়েছিল। প্রথম দিকে গড়ে ওঠা এবং স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলনে সক্রিয় বাংলার বৈপ্লবিক গোপন সমিতিগুলি গণ-আন্দোলনে মন্দাভাব দেখা দেয়ার পর রাজনৈতিক নৈরাজ্যবাদের কৌশল গ্রহণ করে। বাংলার গোপন সমিতির মধ্যে ঢাকার অনুশীলন সমিতি ও কলকাতায় যুগান্তর পার্টিই প্রধান ছিল। ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রকে সভাপতি করে ১৯০২ সালের ২৪ মার্চ কলকাতায় বিপ্লবী অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পরে এর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৯ কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, বর্তমানে বিধান সরণিতে। এর প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সতীশচন্দ্র বসু।[২] ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুশীলন সমিতি তৈরী করলেন পুলিন বিহারী দাস।
মূল নিবন্ধ: যুগান্তর দল
যুগান্তর দল বা যুগান্তর সমিতি ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯০৬ সালে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিপ্লবী সমিতিগুলির উদ্দেশ্য
ঢাকা এবং কলকাতা ছাড়াও অন্যান্য শহর, এমন কি গ্রামেও এগুলি তাদের শাখা গঠন করেছিল। পুস্তিকা ও কলিকাতার ‘যুগান্তর’-এর সংবাদ অনুসারে এই বিপ্লবী সমিতিগুলির আরব্ধ লক্ষ্য ছিল: ভারতীয় যুবকদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য লালন, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সম্ভাব্য যে কোনো পথে সংগ্রাম চালানোর প্রস্তুতি এবং পরিশেষে সশস্ত্র আক্রমণ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্যোগ। গোপন সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বর্তমান রণনীতি’ নামক পুস্তিকার বক্তব্য অনুসারে: ‘যদি অন্য কোন উপায়ে শোষণের অবসান ঘটান না যায়, যদি দাসত্বের কুষ্ঠরোগ আমাদের জাতির রক্তকে বিষাক্ত করে তোলে ও তার জীবনীশক্তি শুষে নেয়, তবে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে।[৩]
রবীন্দ্রনাথের বোন সরলাদেবী এবং বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাও এই সময়ের বাংলার বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সরলাদেবী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিত হন, এবং বিপ্লবী কাজকর্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
নিবেদিতা ভারতবর্ষে আসার কিছুদিনের মধ্যেই বিপ্লবী প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত হন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণ মিশনের বাইরে থেকে নিবেদিতা রাজনৈতিক জগতে সক্রিয় অংশ নেন। নিবেদিতা সম্ভবত রাশিয়ান অনার্কিষ্ট (Anarchist) নেতা পিটার ক্রোপটকিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। নিবেদিতার সঙ্গে অরবিন্দর দেখা হয় বরোদায়। অরবিন্দকে তিনি কলকাতার গুপ্তসমিতিগুলির খবর দেন। এছাড়া বাংলার গুপ্তসমিতিতে দুষ্প্রাপ্য ম্যাতসিনির (Matzzim) আত্মজীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেন।[৪]
১৯০৮ খ্রীস্টাব্দেই বাংলা ও মহারাষ্ট্রে প্রথম সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক সরকার নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা গ্রহণ করে; হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের মত্যুদণ্ড এবং গুপ্তসমিতির সদস্যদের দীর্ঘমেয়াদী বা কঠোর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯০৮-১৯০৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ‘মানিকতলা গার্ডেন সোসাইটি’, ‘অভিনব ভারত’ ও ‘অনুশীলন সমিতি’র বিলুপ্তি ঘটে এবং বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যয়, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পুলিনবিহারী দাস, ভূপেশচন্দ্র নাগ ও সাভারকর ভাইদের সহ বিপ্লবী সমিতির নেতৃবৃন্দ জেলবন্দী হন। কিন্তু এইসব নির্যাতন সত্ত্বেও বৈপ্লবিক কার্যকলাপ পুরাপুরি থেমে যায় নি। নিশ্চিহ্ন সমিতিগুলির স্থলে নতুন দল ও সংগঠন দেখা দিতে থাকে। প্রথম মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে বারাণসীতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতির একটি শাখা, মহারাষ্ট্রে ‘অভিনব ভারত সমিতি’, কলিকাতায় ‘রাজাবাজার সমিতি’ ও পূর্ববঙ্গে ‘বরিশাল সমিতি’ ইত্যাদি খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ এবং পুলিশের দালাল শ্রেণীর ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস অব্যাহত থাকে। ১৯০৯-১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এইরূপ ৩২টি ঘটনা ঘটে। ১৯১২ খ্রীস্টাব্দে বিপ্লবীরা ভাইসরয় হার্ডিঞ্জকে হত্যার চেষ্টা করে এবং বোমা বিস্ফোরণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।
বিপ্লবী আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই বাংলার প্রথম যুগের বিপ্লব প্রচেষ্টায় উদ্যোক্তাদের অন্যতম ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নিবেদিতার প্রচার কার্য সম্বন্ধে বলেছিলেন ম্যাতসিনির আত্মজীবনীর ছয় খণ্ডের প্রথম খণ্ডটি তিনি বৈপ্লবিক সমিতিকে প্রদান করেন…..এই পুস্তকের শেষে, গেরিলা যুদ্ধ কি প্রকারে করিতে হয় তৎ বিষয়ে একটি অধ্যায় আছে। ইহা টাইপ করিয়া চারিদিকে প্রেরিত হইত,…এই যুদ্ধ পদ্ধতিই আমাদের লক্ষ্য ছিল।” (সুপ্রকাশ রায়, ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড পৃ ১৪৯)।
জাপানি অধ্যাপক ওকাকুরা কিছুদিন বেলুড় মঠে বসবাস করেছিলেন। তার আইডিয়াল অফ দি ইস্ট (Ideal of the East) গ্রন্থে, ইওরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদের পদানত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মুক্তির কথা বলা হয়। ওকাকুরা, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নিবেদিতা এবং হেমচন্দ্র মল্লিকের সঙ্গে একটি সংগঠন তৈরী করেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী তরুণদের মনে বিপ্লবী চিন্তা ও চেতনা জাগিয়ে তোলা।
ভারতীয় আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের দ্বারা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের এই কৌশল গ্রহণ অনেকাংশেই ইউরোপীয় বিপ্লবী সংগঠনের, বিশেষত রাশিয়ার প্রভাবেই ঘটেছিল। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে যুগান্তর পার্টির অন্যতম সদস্য হেমচন্দ্র দাস পশ্চিম ইউরোপে যান এবং নির্বাসিত রুশ বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দের গোড়ার দিকে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ভারতের সর্বত্র বিপ্লবী সমিতিগুলির মধ্যে বোমা ভক্তির বন্যা দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস ভারতীয় বিপ্লবীদের শেষ লক্ষ্য ছিল না। যেসব ব্রিটিশ বা ভারতীয় গুপ্ত আন্দোলনের পক্ষে আশু বিপদের কারণ হয়ে উঠেছিল কেবল তাদের বিরুদ্ধেই এটি প্রযুক্ত হতো। গুপ্তসমিতির নেতৃবৃন্দ সন্ত্রাসকে ভারতীয় সমাজের মধ্যে বৈপ্লবিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির অনুঘটক হিসাবে বিবেচনা করতেন। বাংলার অন্যতম সন্ত্রাসবাদীদের নেতা বারীন ঘোষ লিখেছিলেন যে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা কয়েকজন ব্রিটিশ হত্যার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার কথা ভাবেন নি, তারা কিভাবে বিপদ ও মত্যু বরণ করেন এটা দেখানোই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। তাই বিভিন্ন গুপ্তসমিতির মধ্যে সন্ত্রাসের অর্থ বিভিন্ন রূপে পরিগ্রহ করেছিল। যুগান্তর পার্টির প্রধান উপদল- ‘মানিকতলা গার্ডেন সোসাইটির’ মতে সন্ত্রাসের মধ্যেই তাদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রধান অংশ নিহিত ছিল। কিন্তু গোয়ালিয়রের ‘নবভারত সমিতি’ ও ঢাকার অনুশীলন সমিতি ভাবী অভ্যুত্থানের লক্ষ্যেই তাদের কার্যকলাপ কেন্দ্রীভূত করেছিল।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২৩ অক্টোবর ২০১৯, “ভারতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ভারতের বিপ্লবী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের একটি প্রধান অধ্যায়”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/history/revolutionary-movement-for-indian-independence/
২. চিন্মোহন সেহানবীশ গণেশ ঘোষ ও অন্যান্য, মুক্তির সংগ্রামে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা দ্বিতীয় সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১০ পৃষ্ঠা ৫৬;
৩. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা- ৫১৩-৫১৮।
৪. স্নিগ্ধা সেন, ঐচ্ছিক ইতিহাস, “চরমপন্থা, স্বদেশী আন্দোলন, এবং সুরাটে কংগ্রেসের ভাঙ্গন”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, দ্বিতীয় পুনঃমুদ্রণ জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৪৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।