সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল হচ্ছে জাতির স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পুনরুদ্ধার

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল (ইংরেজি: Results of the Santal Rebellion)  হচ্ছে সাঁওতাল জাতির স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পুনরুদ্ধার, তাঁদের বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি, সাঁওতাল পরগণা গঠন এবং সাঁওতাল পরগণায় তিন বছরের জন্য মহাজনদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে সাঁওতাল পরগণায় ইংরেজদের প্রবেশ বেড়ে যায়, সাঁওতালদের ভেতরে মিশনারিদের কাজ করতে দেয়া হয়। এছাড়াও আরো কিছু ফলাফল নিচে আলোচনা করা হলো।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল মহা-অভ্যুত্থান (১৮৫৫-৫৬) (ইংরেজি: Santhal rebellion) হচ্ছে সাঁওতাল জাতির মুক্তিসংগ্রামের মাইলফলক আধুনিক বর্বরতার প্রতীক ব্রিটিশবিরোধী মহা সংগ্রাম। প্রতি বছর ৩০ জুন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় এই মহান সান্তাল ‘হুল’ দিবসের বার্ষিকী পালিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং উজ্জ্বলতম দিবস এই সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল

সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ও ভারতের কৃষক-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে শুধু উজ্জ্বল আর গৌরবান্বিতই করেনি; বরং সামন্তবাদের রক্ষক বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মোড় নেয়া এই মহাবিদ্রোহ, যা দুই বছর পর ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহকেও উৎসাহ জোগায়। বিদ্রোহীরা বৃটিশদের শান্তি প্রস্তাব তখনই মেনে নেয়, যখন ঐতিহ্যবাহী স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদাসহ তাদের সকল দাবি সরকার পূরণ করে।[১]

সমবেত সাঁওতাল কৃষকেরা সেদিন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় শপথ নিয়েছিলেন। সেদিনের শপথ ছিল বিদ্রোহের শপথ। জমায়েতে সিদ্ধান্ত হয়, অত্যাচারী শোষকদের হাত থেকে রক্ষায় সবাইকে এক হয়ে লড়তে হবে, জমির খাজনা দেওয়া হবে না, প্রত্যেকের যত খুশি জমি চাষ করার স্বাধীনতা থাকবে, নিজেদের মতো করে সরকার কায়েম করা হবে ইত্যাদি। জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ওই বিদ্রোহের পরে এলাকার শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ও বিহারি হিন্দু-মুসলমান গরিব কৃষক এবং কারিগরেরাও যোগ দেন।

হাজার হাজার সাঁওতাল কৃষক মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে ‘জীবনমত্যু পায়ের ভৃত্য করে, অজস্র ধারায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বিদ্রোহের যে আগুন জেলেছিলেন তা ছিল ১৮৫৭ সালের ভারতবর্ষের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত ও প্রেরণা। চল্লিশ বছরব্যাপী ওয়াহাবী বিদ্রোহ ও ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের পরেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহের স্থান। 

সঠিক রাজনৈতিক জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব তৎকালীন সময়ে স্বাভাবিক কারণে না থাকার জন্য এই সাঁওতাল বিদ্রোহ চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু তবু এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। ১৮৭১ এবং ১৮৮০-৮১ সালে একই স্বপ্ন নিয়ে আবার সাঁওতাল বিদ্রোহের মাদল বেজে উঠেছিল। 

সাঁওতাল বিদ্রোহের শিক্ষার আলোকে আলোকিত পথ ধরে ভারতবর্ষের কৃষক জীবনকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য পরাধীন ভারতবর্ষে বার বার বিদ্রোহ করেছে। আজও সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতবর্ষের মানুষের কাছে বিশেষ ভাবে কৃষক সমাজের কাছে যেন এক অনির্বাণ দীপশিখা। পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন, বিনা ক্ষতি পরণে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে জমি বণ্টন, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ, জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এই দাবীগুলির সমাধানের মধ্য দিয়ে যেদিন ভারতবর্ষের সমাজে বিকাশের ধারা উন্মুক্ত হবে সেইদিন সাঁওতাল কৃষকদের স্বপ্ন সার্থক হয়ে ভারত দিগন্তে নতুন সূর্যের উদয় হবে। সাঁওতাল বিদ্রোহসহ অসংখ্য বিদ্রোহের মহান ও গৌরবোজ্জল ঐতিহ্য বুকে নিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষ এই সুর্যোদয়কে ত্বরান্বিত করার পথে রক্তাক্ত হয়েও মত্যু ভয়হীন পদক্ষেপে অগ্রসর হবেই।[২]

সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে আদিবাসীদের আজও গাইতে শোনা যায়, ‘সিদো-কানহু খুড়খুড়ি চাঁদ-ভায়রো ঘোড়া উপরে দেখ সে রে! চাঁদ রে! ভায়রো রে! খোড়া ভায়য়োরে মুলিনে মুলিনে।’ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া সিধু ও কানু পালকিতে এবং চাঁদ ও ভৈরব ঘোড়ায় চড়ে বিদ্রোহীদের পাশে থেকে উৎসাহ দিতেন। হুলে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধারা পরাজয় বরণ করেছেন, আত্মসমর্পণ করেন নাই। সেই যুদ্ধ এখনও চলমান। ভারতের মহান আদিবাসীরা ভারতীয় সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও বিস্তারবাদের বিরুদ্ধে আজো লড়াই জারি রেখেছেন।

তথ্যসূত্র:

১. চিন্মোহন সেহানবীশ গণেশ ঘোষ ও অন্যান্য, মুক্তির সংগ্রামে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা দ্বিতীয় সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১০ পৃষ্ঠা ২০৩
২. অমিত সরকার, “সাঁওতাল বিদ্রোহ”, মাসিক যুবমানস, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যুবকল্যাণ বিভাগ, সপ্তম সংখ্যা, জুলাই ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ২৪৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!