সামন্তবাদ হচ্ছে দাসযুগের পরে মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর শোষণের এক রূপ

সামন্তবাদ বা সামন্ততন্ত্র (ইংরেজি: Feudalism) হচ্ছে দাসমালিকদের যুগের পর, দাস-প্রথার স্থলে মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর শোষণের এক সামাজিক আর্থিক নতুন রূপ। সামন্তবাদ সমগ্র মধ্যযুগ ধরে প্রচলিত ছিল আর এটির বিকাশের সর্বশেষ স্তর ছিল ভূমিদাস-প্রথা। সামন্তবাদ তুলনামূলকভাবে বিকাশের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অধীনস্থ ছিল। সামন্তবাদী ব্যবস্থায় বিশাল কৃষক সাধারণ সামন্ত-ভূম্যধিকারীদের (barons) এক ক্ষুদ্র দল দ্বারা শোষিত হতো। কৃষকরা যে জমিতে চাষ করতো সেই জমির উপর সর্বোচ্চ ক্ষমতা সামন্ত ‘ব্যারন’রা তাদের নিজেদের হাতে রেখেছিল। জমিতে চাষাবাদের অধিকার লাভের বদলে কৃষককে তাদের ভূস্বামীদের বহুসংখ্যক সামন্ত সেবা-কর্মের বশীভূত থাকতে হতো।[১]

যে পর্যন্ত স্বাভাবিক-অর্থনীতি (natural economy), অর্থাৎ বিনিময়ের জন্যে নয়, সরাসরি ব্যবহারের জন্যে উৎপাদন বিরাজমান ছিল, সে পর্যন্ত সামন্ত শোষণ তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল সামন্ত-প্রভুরা তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্যে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিজাত উৎপন্ন-দ্রব্যের একটা নির্দিষ্ট অংশ কেড়ে নিত। এসব উৎপন্ন-দ্রব্যের বড় অংশই ভূস্বামী ও তার সৈন্য-সামন্তরা ভোগ করতো, আর একটা ক্ষুদ্র অংশই কেবল অস্ত্রশস্ত্র, কিছু ভিনদেশীয় দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদির বিনিময়ার্থে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বিনিময়-প্রথার বিকাশ সামন্ত-প্রভুদের লালসা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে তোলে। এখন ভূস্বামী ও চাকর-বাকরদের জন্যে যে কর আদায় করা হতো, কৃষকদের কাছ থেকে সেই কর নিংড়ে নিয়েই তারা ক্ষান্ত হলো না, বরং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর বিনিময়ার্থে জোর করে আদায়কৃত করের পরিমাণও অব্যাহতভাবে বাড়তে লাগলো। বিনিময়-ব্যবস্থা যতই বিকশিত হলো, ততই সামন্ত-প্রভু কর্তৃক কৃষকদের উপর ক্রমবর্ধমান শোষণের সম্ভাবনা বাড়তে থাকলো। বিনিময়-প্রথার বিকাশ সামন্ত-প্রভু ও তার উপর নির্ভরশীল কৃষকদের মধ্যেকার প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক ভেঙ্গে দিল এবং ভূমিদাস-প্রথার উদ্ভবের দিকে চালিত করলো।

ভূমিদাস-প্রথা কৃষকদের উপর জমিদারদের নিষ্ঠুরতম ধরনের এক শোষণের রূপকেই তুলে ধরে। ভূমিদাস-প্রথায় মৌলিক উৎপাদন-যন্ত্র – জমি – ছিল জমিদারদের অধিকারে। পুরুষানুক্রমে কৃষকরা যে জমি চাষাবাদ করে আসছিল সে জমিকে জমিদাররা আত্মসাৎ করে নেয়। কিন্তু তাতেও তারা সন্তুষ্ট থাকলো না। যে রাষ্ট্রক্ষমতা আবার তাদেরই হাতে, সেই ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে তারা পূর্বে মুক্ত কৃষককে তাদের ভূমিদাসে রূপান্তরিত করে। কৃষকরা জমির সাথে থাকে বাঁধা এবং কার্যত জমিদারদের সম্পত্তিতেই পরিণত হয়।

সর্ব উপায়ে নিজেদের আয় বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে জমিদাররা তাদের ভূমিদাসদের উপর শোষণ বাড়িয়ে দেয়। ভূমিদাস-প্রথার যুগে পূর্ব থেকেই বিনিময়-প্রথা বেশ পরিমাণে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছিল। বণিকেরা সামন্ত ভূমিদাস-মালিকদের সকল ধরনের বিদেশী দ্রব্য-সামগ্রী সরবরাহ করতো। মুদ্রা অধিক থেকে অধিকতর মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আরো বেশী মুদ্রা হস্তগত করার উদ্দেশ্যে ভূমিদাস-মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে অধিক থেকে অধিকতর শ্রম নিংড়ে নিতে থাকে। কৃষকদের হাত থেকে তারা জমি কেড়ে নেয়, বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণ সীমাবদ্ধ করে দেয়; এবং এগুলোর স্থলে তাদের নিজেদের খামার স্থাপন করে, যে খামারে ঐ একই কৃষকদের কাজ করতে তারা বাধ্য করে। বেগার খাটার প্রথা (corvee service) চালু করা হয়: প্রভুর খামারে সপ্তাহের তিন বা চার দিন কৃষককে কাজ করতে হবে, আর নিজের বরাদ্দকৃত জমিতে কেবলমাত্র অবশিষ্ট দিনগুলোতেই কাজ করতে পারবে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে, কৃষকদের “কাজের বদলে খাজনা” (quitrent) পরিশোধের ব্যবস্থা দ্বারা ভূমিদাস-মালিক জমিদাররা কৃষকের মাঠ থেকে ফসলের ক্রমবর্ধমান অংশ আত্মসাৎ করে নেয়।

ভূমিদাসদের উপর শোষণ জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সবচেয়ে তিক্ত সংগ্রামের জন্ম দেয়। প্রত্যেক দেশের ইতিহাসেই বিপুল সংখ্যক কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা নজরে পড়ে। ভূমিদাস-প্রথার যুগে বহু দেশেই (যেমন, জার্মানী, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, রাশিয়াতে) কৃষক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এসব কোনো কোনো অভ্যুত্থান কয়েক দশক ধরে টিকে ছিল। এইসব দেশ দশকের পর দশক ধরে গৃহযুদ্ধের কবলে ছিল। জমিদারেরা ও তাদের সরকার এসব অভ্যুত্থানকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। সামন্তবাদ ও ভূমিদাস-প্রথার পতন ত্বরান্বিত করা এবং ভূমিদাস শোষণের পরিবর্তে পুঁজিবাদী শোষণ প্রতিষ্ঠার জন্যে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই সংগ্রামকে কাজে লাগায়। 

এক সামাজিক-প্রথার রূপ দ্বারা অন্য সামাজিক-প্রথার রূপকে স্থলাভিষিক্ত করা প্রসঙ্গে স্তালিন বলেছেন: 

“দাসদের বিপ্লব দাস-প্রথার অবসান ঘটায় এবং শ্রমজীবী জনগণকে শোষণ করার দাসতান্ত্রিক প্রথাকে বিলুপ্ত করে। তদস্থলে তা প্রবর্তন করে সামন্ত শাসক ও শ্রমজীবী জনগণকে শোষণের ভূমিদাস-প্রথা। এক দল শোষকের স্থান দখল করে আরেক দল শোষক। দাসপ্রথার যুগে ‘আইন’ দাস-মালিককে দিয়েছিল দাসদের হত্যা করার অধিকার। ভূমিদাস-প্রথায় ‘আইন ভূমিদাসমালিককে কেবলমাত্র দিয়েছিল ভূমিদাসকে বিক্রী করার অধিকার।

“ভূমিদাস-কৃষকদের বিপ্লব ভূমিদাস-মালিকদের ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং শোষণের ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। কিন্তু এগুলোর স্থলে তা প্রবর্তন করে পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের, শ্রমজীবী জনগণকে শোষণের পুঁজিবাদী ও ভূস্বামী-প্রথা। এক দল শোষকের স্থান দখল করে আরেক দল শোষক। ভূমিদাস ব্যবস্থায় ‘আইন’ দিয়েছিল ভূমিদাসদের বিক্রী করার অধিকার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ‘আইন’ শ্রমজীবী জনগণকে কেবলমাত্র দিয়েছে বেকারত্ব ও দারিদ্রের শিকারে পরিণত হওয়ার, অনাহারে ধ্বংস ও মৃত্যুবরণ করার অধিকার।

“একমাত্র আমাদের সোভিয়েত বিপ্লব, একমাত্র আমাদের অক্টোবর বিপ্লবই প্রশ্নটিকে এভাবে উপস্থিত করেছে – এক দল শোষকের স্থলে আরেক দল শোষককে অভিষিক্ত করা নয়, এক রূপের শোষণের স্থলে আরেক রূপের শোষণকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়, বরং সকল শোষণকে মুছে ফেলা, সকল ও প্রত্যেক ধরনের নতুন ও পুরাতন ধনিক ও নিপীড়কদের নিশ্চিহ্ন করা।”[২]

তথ্যসূত্র

১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ২২-২৩।

২. জোসেফ স্তালিন, যৌথ খামার শক ব্রিগেডে’র প্রথম নিখিল-রুশ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ, পৃঃ ৮

Leave a Comment

error: Content is protected !!