খাসি বিদ্রোহ বা খাসিয়া বিদ্রোহ (ইংরেজি: Khasi rebellion) হচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদিদের বিরুদ্ধে খাসি জনজাতির অভ্যুত্থান। সমাজের প্রভাবশালী সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট আদিবাসী ও উপজাতি হিসেবে পরিচিত বাংলার সংখ্যালঘু জনগণ প্রধানত পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণের সীমান্তে উপ-পার্বত্য (sub-montane) অঞ্চলে বাস করতো। সীমান্তের প্রান্তিক সমাজ হিসেবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো বাঙালিদের থেকে অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো। এমনকি তারা নিজেরাই একে অপর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো। প্রতিটি আদিবাসীর নিজস্ব এলাকা এবং জীবনপ্রণালী ছিল। স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রে প্রতিটি আদিবাসী স্ববিবর্তিত ব্যবস্থা অনুসারে জীবন যাপন করতো এবং তারা কদাচিৎ বহিঃস্থ প্রভাব ও হস্তক্ষেপের প্রভাবাধীন ছিল।[১]
প্রাক-বৃটিশ সকল শাসক এসব আদিবাসীর এলাকাকে মধ্যবর্তী অঞ্চল (buffer states) হিসেবে গণ্য করতো এবং কদাচিৎ তাদের এলাকায় হস্তক্ষেপ করতো। কিন্তু বর্বর অসভ্য ইতর ব্রিটিশ কোম্পানি সরকার এ সকল সীমান্ত-অঞ্চলকে রাজস্বের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে। উপ-পার্বত্য এলাকাসমূহকে কোম্পানি রাষ্ট্রের আওতাধীনে আনা হয় এবং আদিবাসী জনগণকে নগদ অর্থ বা দ্রব্যে রাজস্ব পরিশোধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ ধরনের বিনিময়ের মাধ্যম আদিবাসী জনগণের নিকট অজ্ঞাত বিষয় ছিল।
আদিবাসী সমাজগুলোর নিকট রাষ্ট্রের আইনের বশ্যতা স্বীকার এক অজানা অভিজ্ঞতা ছিল এবং স্পষ্টত তারা এ জাতীয় বশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই যে বর্বর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহের মধ্যে একটা ধনাত্মক সম্পর্ক ছিল। এ বক্তব্যের সপক্ষে অনেক উদাহরণের মধ্যে মাত্র তিনটি প্রতিনিধিত্বশীল খাসি, চাকমা ও সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক।
খাসি জাতির বিদ্রোহ
স্থানীয় জনগণকে, বিশেষকরে খাসি জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ১৭৭২ সালে রবার্ট লিন্ডসেকে সিলেটে রেসিডেন্ট (Resident) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি এ অঞ্চল সম্পর্কে মানসিক জরিপ চালিয়ে পাহাড়ী সমাজে ব্যবসা ও বাণিজ্যের বিপুল সম্ভাবনা লক্ষ্য করেন। খাসি পাহাড়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে জাহাজ নির্মাণসামগ্রী, কাঠ, লোহা, সিল্ক, মোটা বা অসূক্ষ্ম মসলিন, হাতির দাঁত, মধু, আঠা, কমলা, লেবু ইত্যাদি পাওয়া যেতো। কিন্তু খাসি জনগণের অর্থনীতি কোম্পানির সাথে ব্যবসা করার অনুকূল ছিল না। অধিকন্তু লিন্ডসে মন্তব্য করেন, “গ্রামের প্রত্যেক চীফ (chief) নিজেকে রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং নিজস্ব এলাকায় তাঁর স্বাধীন সরকার রয়েছে। গ্রামে চীফের স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পর্কে লিন্ডসে আরো উল্লেখ করেন, “তারা নিজস্ব ধারণায় পুরোপুরি স্বাধীন। আমি রাজা ও প্রধান ব্যক্তিদের সাথে প্রায়শ পূর্বে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎ করেছি, কিন্তু একেবারে সমভাবে তা সম্ভব হয় নি, কিছু ক্ষেত্রে তারা সাক্ষাৎ দানে অস্বীকার করে। তারা আমাকে কোনো উচ্চ পর্যায়ের মর্যাদা দেয় নি এবং নিজেদের পরিণাম সম্পর্কে তারা ছিল নাছোড়বান্দা (tenacious)।”[২] লিন্ডসের মতে, ব্যবসার উদ্দেশ্যে পাহাড়ী সমাজে অনুপ্রবেশ করা তাদের স্বাধীন মর্যাদা ক্ষুন্ন না করে সম্ভব ছিল না। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র খাসি জনগোষ্ঠীকে কোম্পানি সরকারের আওতাধীনে আনার জন্য সীমিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং তা পাহাড়ী জনগণের তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের কারণ হয়।
খাসিরা পশ্চিমে পান্দুয়া থেকে পূর্বে লাউর পরগনা পর্যন্ত সমতলের জমিদারদের সাথে আঁতাত করে এবং কোম্পানির রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াকে নাজেহাল করে।[৩] খাসি জনগোষ্ঠীর সংহতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে সরকার সফলতার সাথে চীফদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে এবং তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করে। ১৭৮৩ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত খাসি জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকৃত সমতল ভূমি থেকে বের করে পাহাড়ের দিকে ঠেলে দেয়ার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে তাড়িয়ে পাহাড়ে উদ্বাস্তু করার পর আপোস-মীমাংসার দ্বার উন্মুক্ত করা হয় এবং বলা হয় যে তারা শান্তিপূর্ণ আচরণ সাপেক্ষে কোম্পানির এলাকায় ব্যবসার উদ্দেশ্যে খোলাখুলি আদান-প্রদান করতে পারবে; তাদেরকে সশস্ত্রভাবে চলার অনুমতি প্রদান করা হবে না; এবং যদি তারা কোম্পানির চৌহদ্দিতে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করে অথবা তাদের এলাকায় আক্রমণ চালায়, তবে ব্যক্তিগত শত্রু ও অনধিকারপ্রবেশকারী হিসেবে তাদের শাস্তি প্রদানের নির্দেশসহ তাদের অঞ্চলে তৎক্ষণাৎ সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা যাবে।”[৪] খাসি প্রতিরোধ (The Khasi Resistance) আন্দোলনের নায়ক ছিলেন গঙ্গা সিং, যাকে বৃটিশ বাহিনী বন্দি করে। কোম্পানিকে অবজ্ঞা করার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
তথ্যসূত্র
১. সিরাজুল ইসলাম, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহ”, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৫।
২. Lindsay’s ‘Report on Khasis’, 14 December 1787. cited in Nisith Ranjan Ray (ed.), Challenge: A Saga of India’s Struggle for Freedom (New Delhi 1984, 133.
৩. Collector of Sylhet, Willes, to Goveror General Cornwallis, 18 November 1789, cited in ঐ, 135.
৪. খাসি জনগোষ্ঠী ও কোম্পানির দ্বন্দ্বের ব্যাপারে সিলেটের জেলা কালেক্টর এবং সপরিষদ গভর্নর জেনারেল ও রেভিনিউ বোর্ডের মধ্যে অনেক চিঠির আদানপ্রদান হয়। দেখুন, ঐ, i34, i39,12.
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।
লেখাটি সুন্দর হয়েছে। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।