এনামূল হক পলাশ একজন লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক

এনামূল হক পলাশ একজন বাংলা ভাষার সহজিয়া ধারার একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক, গীতিকার এবং সংগঠক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৬ জুন ১৯৭৭ সালে নেত্রকোণায়। তিনি বামপন্থী বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার একজন কর্মী ছিলেন। এনামূল হক পলাশ ‘অন্তরাশ্রম’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং একই নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনা করেন। তার স্বপ্ন ‘অন্তরাশ্রম’ একদিন শান্তি নিকেতনের মতো আন্তর্জাতিক আনন্দশিক্ষালয় হিসেবে গড়ে উঠবে।

এনামূল হক পলাশ নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা উপজেলার বাদেচিরাম গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস একই উপজেলার বামনগাঁও গ্রামে। পিতা মরহুম এমদাদুল হক। এবং মাতা নুরুন্নাহার হক।

প্রথমে এনামূল হক পলাশ বারহাট্টার গোপালপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেনীতে ভর্তি হন এবং এক বছর পরে বারহাট্টা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে একই স্কুল থেকে ১৯৮৮ সালে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। বারহাট্টা সি.কে.পি. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করে অস্টম শ্রেনীতে সাধারণ বৃত্তি পান এবং পরের বছর ড. ইন্নাছ আলী বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৪ সালে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৯৯৪ সালে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী থেকে প্রকাশিত মাটির সুবাস নামক একটি পত্রিকায় এনামূল হক পলাশের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয় ইন্টারমিডিয়েট কলেজে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করে ১৯৯৬ সালে প্রথম বিভাগে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় নিয়মিত লেখা ছাপা হতো। ১৯৯৭ সালে সরকারী তিতুমীর কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনার্স ভর্তি হন। ১৯৯৮ সালে পারিবারিক কারণে নেত্রকোণা সরকারী কলেজে চলে আসেন এবং একই কলেজ থেকে ২০০২ সালে দ্বিতীয় শ্রেনীতে স্মাতক (সন্মান) উত্তীর্ণ হন। তারপরে গুরু দয়াল সরকারী কলেজে মাস্টার্স ভর্তি হয়ে ২০০৪ সালে উদ্ভিদ বিদ্যায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৯৯৮ সালে একটি প্রগতিশীল বাম সংগঠনের সাথে এনামূল হক পলাশের যোগাযোগ স্থাপন হয় এবং তিনি প্রগতিশীল বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সময় কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাথে যুক্ত থেকে সাংবাদিকতা করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি রাজনীতি ছেড়ে ভূমি কর্মকর্তার সরকারী চাকুরিতে যোগদান করেন।

২০০৫ সালে পারিবারিক সম্মতিতে নেত্রকোনা শহরে মাহবুবা এনাম সোমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী পেশায় একজন প্রাইমারী শিক্ষক ও ‘অন্তরাশ্রম’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।

এনামূল হক পলাশের প্রথম কবিতার বই ‘অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ চাই’(২০০৯) প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘জীবন এক মায়াবী ভ্রমণ’ (২০১৫), তৃতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘অন্ধ সময়ের ডানা’ (২০১৬)। তারপরে ‘লেখা প্রকাশ সাহিত্য সন্মাননা- ২০১৬’ এবং বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটি কর্তৃক ‘অমর একুশে স্মৃতি পদক- ২০১৬’ প্রাপ্ত হন। ২০১৬ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোণার মালনী এলাকায় বিশ্ব কবিতার আবাসস্থল বা হোম অব ওয়ার্লড পয়েট্রি খ্যাত ‘কবিতাকুঞ্জ’ প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে অবকাঠামো গঠনের কাজে যুক্ত থেকেছেন এবং একই প্রতিষ্ঠানের প্রথম পরিচালক হিসেবে কবি কর্তৃক নিযুক্ত আছেন।

কবি, লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীদের ব্যবহারের জন্য তিনি নেত্রকোনা শহরের মালনী এলাকায় ২০১৭ সালে গড়ে তুলেছেন অন্তরাশ্রম নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডা, অসহায় মানুষদের সহায়তা, শীতার্ত মানুষদের শীতবস্ত্র বিতরণের মধ্যে প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিলো। মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কবি এনামূল হক পলাশ এসময় স্কুল অফ মোরাল সাইন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান কল্পনা করেন যেটি অন্তরাশ্রম নামে নেত্রকোণায় পরিচিত হয়। কবি এনামূল হক পলাশ এই প্রতিষ্ঠানের আচার্য্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। সেই সাথে তিনি একই নামে একটি সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রকাশ করেন।

অন্তরাশ্রম একটি প্রতিষ্ঠান যেটি বিশ্ববীক্ষায় দীক্ষিত।  আন্তর্জাতিকতাবাদকে ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী অবস্থানকে অন্তরাশ্রম সব সময় শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এই ধারণাকে সামনে রেখে এই প্রতিষ্ঠান থেকে একই নামে অর্থাৎ অন্তরাশ্রম নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে ইংরেজি ২০১৮ সালের আগস্ট বাংলা ১৪২৫ সালের ভাদ্র মাসে এর প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ইংরেজি ২০১৯ সালের অক্টোবর বাংলা ১৪২৬ সালের আশ্বিন মাসে এর দ্বিতীয় সংখ্যা ও ইংরেজি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি বাংলা ১৪২৬ সালের ফাল্গুন মাসে এর তৃতীয় সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। বর্তমানে ইংরেজি ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলা ১৪২৭ সালের ১৫ অগ্রহায়ণ এর চতুর্থ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে।

অন্তরাশ্রমের মূল স্লোগান হচ্ছে “অনন্ত জীবনের গান গাই”। এটি নিশ্চিত একটি ভাববাদী স্লোগান। অন্তরাশ্রম ভাববাদে দীক্ষিত একটি প্রতিষ্ঠান হলেও বস্তুবাদকে অস্বীকার করলে অন্তরাশ্রমের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে এরকমটা মনে করেন অন্তরাশ্রমের আচার্য্য ও সাহিত্য পত্রিকাটির সম্পাদক  কবি এনামূল হক পলাশ।

২০১৭ সালে চতুর্থ কাব্য গ্রন্থ ‘অন্তরাশ্রম’ ও পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘের সন্ন্যাস’ প্রকাশিত হয় এবং নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার চর্চা সাহিত্য আড্ডা কর্তৃক তাদের শততম আসরে অন্যান্যদের সাথে ‘চর্চা শুভেচ্ছা সন্মাননা- ২০১৭’ প্রাপ্ত হন।

২০১৮ সালে ষষ্ঠ কাব্য গ্রন্থ ‘পাপের শহরে’ প্রকাশ হয় এবং কবির চল্লিশ পূর্তি উপলক্ষে কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘আশ্রম পাখির মায়াপথ’ নামে একটি প্রকাশনা গ্রন্থ বের হয়। ২০১৯ সালে সপ্তম কাব্য গ্রন্থ ‘জল ও হিজল’ প্রকাশিত হয়। একই সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে কূপিবাতি নামক একটি ভাষ্কর্য স্থাপন করেন।

আরো পড়ুন

২০২০ সালে একটি শিশুতোষ বই ‘বইয়ের পাতায় ফুলঝুরি’ এবং ‘ভূমি ব্যবস্থাপনার সরল পাঠ’ নামে একটি গবেষণাধর্মী বই প্রকাশিত হয়। একই বছর তিনি ভারত ভ্রমণ করেন। ২০২১ সালে অষ্টম কাব্যগ্রন্থ ‘তামাশা বাতাসে পৃথিবী’, শিশুতোষ বই ‘কলমি লতার ফুল’ এবং ‘ধর্মবিশ্বাস আখ্যানের মতো সুন্দর’ নামে একটি প্রাচীন আরবী সাহিত্যের কবিতা অনুবাদ বই প্রকাশিত হয়।

এনামূল হক পলাশ ২০২১ সালে নেত্রকোণায় একটি ‘ভূমি জাদুঘর’ (ভূমি ও কৃষি উপকরণ প্রদর্শনশালা) প্রতিষ্ঠার ধারণাপত্র তৈরি করেন এবং পরবর্তীতে তার ধারণার উপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নেত্রকোণার মেছুয়া বাজার সংলগ্ন পুরাতন সদর কাচারিকে ভূমি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

২০২২ সালে নবম কাব্যগ্রন্থ ‘অখন্ড জীবনের পাঠ’, দশম কাব্যগ্রন্থ ‘লাবণ্য দাশ এন্ড কোং’ ও শিশুতোষ বই ‘মগড়া নদীর বাঁকে’ এবং ‘মু-আল্লাক্বা’ নামে প্রাচীন আরবী সাহিত্যের কবি ইমরুল কায়েসের কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। একই বছর তার কিছু কবিতা নিয়ে ইংরেজিতে ভাষান্তরিত বই Crossing Forty Nights প্রকাশিত হয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাবুই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে পাখপাখালির ছড়া নামে একটি শিশুতোষ বই।

ঋত্বিক ঘটকের একটি তথ্যচিত্র দেখুন

এছাড়াও এনামূল হক পলাশ ‘গণতন্ত্রের গান’ ও ‘রাত্রির গান’ নামক দুটি গানের গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার এ দুটি গানসহ ‘বাউলজন্মের গান’ নামক আরেকটি গান দেশে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। 

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, দোলন প্রভা, নেত্রকোণা জেলা চরিতকোষ, টাঙ্গন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, জুন ২০২৪, পৃষ্ঠা ২১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!