যুগান্তর দল বা যুগান্তর সমিতি (ইংরেজি: Jugantar বা Yugantar Samiti) ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম, ব্যায়ামচর্চা, চরিত্রগঠন, সমাজসেবা ও দেশাত্মবোধক নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯০৬ সালে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৬ সালে কোলকাতা অনুশীলন সমিতি থেকে একটি মুখপত্র প্রকাশিত হয়, যার নাম ছিল “যুগান্তর”; এবং এটার সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
উপনিবেশবাদ বিরোধী সশস্ত্র লড়াই এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে যে চারটি দল তাদের ভেতর অনুশীলন ও যুগান্তর দল ছিলো প্রধান সারিতে। পরে এসেছে কমিউনিস্ট পার্টি এবং ফরোয়ার্ড ব্লক। বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের ধরণ নিয়ে অনুশীলন সমিতির সতীশচন্দ্র বসু এবং পুলিনবিহারী দাসদের সাথে ক্রমশ অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমুখের বিরোধ বাধে। তার ফলশ্রুতিতে অনুশীলন সমিতি ভেঙে যুগান্তর সমিতি গঠিত হয়।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষরা ছিলেন সশস্ত্র আন্দোলন ও গুপ্ত হত্যার পক্ষপাতী। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস — এই ছিল তাদের বিশ্বাস। তাই তারা গোপনে আলাদা দল খোলার সিদ্ধান্ত নেন। বাংলার সর্বত্র বিভিন্ন পুস্তক ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে বিপ্লবী ভাবধারা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় । এইসব বিপ্লবী পত্রপত্রিকাগুলির মধ্যে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “ভবানী মন্দির” এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে অবিনাশ ভট্টাচার্য প্রণীত “বর্তমান রণনীতি” গ্রন্থ দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নবগঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের অত্যাচারী ব্রিটিশ সন্ত্রাসবাদী লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে নৈহাটি স্টেশনে হত্যার জন্য বারীন্দ্রকুমার ঘোষ কলকাতার মানিকতলা অঞ্চলে ৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের এক বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির কারখান স্থাপন করেন। হেমচন্দ্র কানুনগো ও প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র উল্লাসকর দত্ত এই বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির দায়িত্ব নেন। যদিও তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হয় নি। বারীন ঘোষ, অরবিন্দ, হেমচন্দ্র কানুনগোসহ ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করে “আলিপুর বোমা মামলা” শুরু হয়।
বার্লিনে অবস্থানকারী বলশেভিক বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় ওরফে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সাথে (ইনিই তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া তৈরি করেন) যুগান্তর পার্টির যোগাযোগ ছিল। সোয়ের এবং সুল কর্তৃক নির্মিত থার্টি টু বোর-এর জার্মান অটোমেটিক পিস্তল সর্বপ্রথম ভারতে আসে তার শিষ্য যুগান্তর দলের সদস্য অবনী মুখার্জীর ভারত সফরের সময়।
পাশাপাশি যুগান্তর দলের একটি অংশ সশস্ত্র বিপ্লব থেকে সরে এসে কংগ্রেসের সাথে আঁতাত করে। ১৯২৩ সালের শেষের দিকে যুগান্তর দলের অনেক নেতা বাংলার জেলা ও প্রাদেশিক কংগ্রেসের, এমনকি জাতীয় কংগ্রেসের উঁচু পর্যায়ে পৌঁছুতে সক্ষম হয়। যুগান্তর দলের ভূপতি মজুমদার ও মনোরঞ্জন গুপ্ত যথাক্রমে ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদক। অসহযোগ আন্দোলনের সময় কংগ্রেস কর্তৃক গঠিত জাতীয় সেচ্ছাসেবী কোর নিয়ন্ত্রিত হতো বিপ্লবী দলগুলির মাধ্যমেই। এর মধ্যে যুগান্তরও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অনুশীলন ও যুগান্তর দুই দলের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল এমন ত নয়ই, যথেষ্ট নৈকট্য ছিল। এমনকি সে সময়ের ব্রিটিশ পুলিশ অনুশীলন সমিতির কোলকাতা শাখাকেই “যুগান্তর দল” নামে চিহ্নিত করেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় যুগান্তর দল গান্ধীর সাথে সহযোগিতা করে, কিন্তু ঢাকা অনুশীলনদল তাদের বৈপ্লবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯২৪ সালে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় জেলখানায় উভয় দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ঢাকা অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর উভয় দলের সদস্য সূর্যসেন ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর কাজ পরিচালনা করেন। সাথে আরো বৃহত্তর পরিকল্পনা ছিল এঁদের, যেমন — হোটেল, ক্লাব ও সিনেমা হলগুলিতে ইউরোপীয়দের হত্যা, দমদমের (কলকাতা) বিমানঘাটিতে অগ্নিসংযোগ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করে কলকাতায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা, বজবজ-এর পেট্রোল ডিপোগুলি ধ্বংস করে কলকাতায় পেট্রোল সরবরাহ বন্ধ করা, ট্রাম সার্ভিসের যোগাযোগ রক্ষাকারী তারগুলি বিচ্ছিন্ন করে কলকাতায় ট্রাম ব্যবস্থা বিঘ্নিত করা ইত্যাদি।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল রাত দশটায় পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা গোলাবারুদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। তবে বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা — এই নামের অধীনে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী এই বিপ্লবে অংশ নেন। সফল বিপ্লবের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হন এবং সেখানে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারী স্যালুট প্রদান করা হয়। সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন।
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে খবর যায়। বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের কাছে জালালাবাদ পাহাড়ে ডেরা বাধে।সেখানেই দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধে বারোজন বিপ্লবী শহীদ হন। এই যুদ্ধ “জালালাবাদের যুদ্ধ” নামেও পরিচিত। মাস্টারদা, প্রীতিলতা প্রমুখেরা পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। বছর দুই পরে প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় (১৯৩২)। প্রায় ৫৩ জন ব্রিটিশকে হত্যা করা হয়।
১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেত্র সেনের বিশ্বাসঘাতকতায় মাস্টারদা ধরা পড়েন।শুরু হয় মামলা।১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর হবার কথা উল্লেখ করা হয়। মাস্টারদা’র মৃত্যুর পর সমিতির কাজও আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে থাকে। বাকি লোকজন কংগ্রেসী আন্দোলনের সাথে মিলে যান।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।