নীল বিদ্রোহ বা নীল প্রতিরোধ আন্দোলন ছিল কৃষক আন্দোলন

নীল বিদ্রোহ বা নীল প্রতিরোধ আন্দোলন (ইংরেজি: Indigo revolt) ছিল কৃষক আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে নীল খামারীদের বিরুদ্ধে নীল চাষীদের অভ্যুত্থান হয়েছিল। কোম্পানি শাসনে অনেক অর্থকরী ফসল প্রবর্তন করা হয়, যেগুলোর একটি হলো নীল—এক জাতীয় রঙীন গাছ। রাজস্ব পরিশোধের জন্য কৃষকদের নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল এবং নীল চাষ তাদেরকে এই নগদ অর্থ লাভের উত্তম সুযোগ এনে দেয়। এই শস্য প্রাচীনকাল থেকে ঘরোয়াভাবে (domistically) উৎপাদিত হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ইউরোপীয়দের দ্বারা তা বাজারজাত করা হতো এবং ১৮২০-এর দশক থেকে ব্যাপক আকারে এর চাষ সম্প্রসারিত করা হয়। ১৮২৯ সাল নাগাদ যখন ইউরোপীয় আবাদকারীগণ (planters) প্রথম বারের মতো গ্রামাঞ্চলে জমিদারি ব্যবস্থার অধিকারী হয় এবং কর্তৃত্ব অর্জন করে, তখন নীলচাষীরা এ আবাদে খুশী হয়, কারণ নীল খামারে সহনীয় শ্রমের বিনিময়ে তারা নগদ অর্থ লাভ করে। কিন্তু এ সম্পর্কটি বেনটিঙ্ক-এর শাসনামলে পরিবর্তিত হয়।[১]

মজুরি শ্রমিক দ্বারা নীল উৎপাদনের কৌশল নীলের রায়তী আবাদ অধিকভাবে চালু করে। নীলকরগণ (Indigo planters) এস্টেটসমূহের মালিক ছিলেন এবং তারা প্রজাদেরকে ক্রমবর্ধমান হারে অসুবিধাজনক শর্তে নীল চাষে বাধ্য করতেন। যতদিন পর্যন্ত নীল যথেষ্ট মুনাফা অর্জনকারী খাত ছিল, নীলচাষীরাও উচ্চ মজুরি হারের ভাগ পেত। কিন্তু ১৮৪০ এবং ৫০-এর দশকে বিশ্বে নীলের বাজারে ভয়ানক মন্দা দেখা দেয় এবং ফলশ্রুতিতে নীল রায়তদের মুনাফাও কমে যায়। ১৮৫০-এর দশকের শেষ দিকে প্রজাদের জন্য নীলচাষ লোকসানের খাতে পরিণত হয়। হিসাব করা হয়েছিল যে এক বিঘায় নীল চাষ করতে প্রজারা ২ থেকে ৩ রূপী খরচ করতো এবং উৎপাদিত শস্যের জন্য নীলকরদের কাছ থেকে প্রায় সমান অথবা কম অর্থ লাভ করতো।

প্রজারা ঐ শস্য উৎপাদনে আইনত বাধ্য ছিল, কারণ নীলকরদের কাছ থেকে তারা যে অগ্রিম নিত তা কদাচিৎ তারা পরিশোধ করতে পারতো। হিসাব বইতে তাদের বকেয়া পুঞ্জীভূত হতো। এ পরিপ্রেক্ষিতে শস্য উৎপাদনে অনাগ্রহী রায়তদেরকে আদালতে অভিযুক্ত করার হুমকি দেয়া হতো, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে নীলকরদেরই প্রভাবাধীন। নীল ক্রমান্বয়ে দমন ও ভীতি প্রদর্শনের প্রতীকে পরিণত হয়। ১৮৫৯ সালে বাংলায় প্রায় ৫০০ নীলকর ১৪৩টি নীলক্ষেতের মালিক ছিল এবং এগুলোর অধিকাংশই নদীয়া ও যশোর জেলায় অবস্থিত ছিল। এবং এ দুই জেলা থেকেই সবচেয়ে হিংস্র বিদ্রোহ শুরু হয়। এর নেতৃত্ব দেন প্রধানত জমিদার এবং মধ্যগ (intermediate) ভূমালিক ও ধনী কৃষকগণ, যারা ক্ষমতা কাঠামোতে নীলকরদের প্রতিপক্ষ ছিলেন।

মুর্শিদাবাদ জেলার আওরঙ্গাবাদ কুঠি থেকে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয় এবং শীঘ্রই তা সকল নীল জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। লেফটেন্যান্ট গভর্নরের জন্য প্রস্তুতকৃত এক বিশেষ প্রতিবেদনে বিদ্রোহের সাংগঠনিক কাঠামোর নিম্নোক্ত বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে:

নীল চাষের বিরুদ্ধে নিয়মিত এক লীগ (league) প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই এতে শপথ গ্রহণ করে। ঢোল বাজিয়ে এক গ্রামের রায়তদেরকে অন্য গ্রামের রায়তদের সহায়তা দানের আহ্বান জানানো হয়। বলা হয় যে যদি তারা নীলকরদের ভৃত্য প্রভৃতির দ্বারা উৎপীড়িত হয় এবং তাদেরকে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হয়, তবে তারা বিরোধিতা করবে; সংকেত প্রেরিত হয় ও চাঁদা তোলা হয়; ঢোলের আহ্বানে গ্রামবাসীরা বেরিয়ে আসে এবং সশস্ত্র অবস্থায় বড় দলভুক্ত হয়ে হুমকিগ্রস্ত স্থানের দিকে অগ্রসর হয়; প্রকৃত পক্ষে তারা নিজেদের পদ্ধতিতে সবকিছু করে, পুলিশরা ভীত হয় এবং রায়তদের দ্বারা পরাভূত হয়।[২]

১৮৬৩ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নীল বিদ্রোহ প্রশমিত হয়। ঐ সময় অনেক নীলকর তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয় এবং তাদের এস্টেট বিক্রি করে দেয়। কিন্তু বাংলায় নীল পুরোপুরি বিলুপ্ত হয় নি। অনেক নীলকর খাজনা হ্রাস করে এবং ভদ্র আচরণ করে প্রজাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে। কিন্তু নীলের বাজার দ্রুত হ্রাস পায়। বিশ্ব বাজারে নীলের চাহিদার ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে নীলকরগণ বাংলায় একের পর এক তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে থাকায় কৃষকগণ স্বস্তি বোধ করে।[৩]

তথ্যসূত্র

১. সিরাজুল ইসলাম, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহ”, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫১-১৫২।
২. Judicial Proceedings, 432-435, June 1860 (B-Proceedings).
৩. নীল বিদ্রোহের উপর উত্তম উৎসগুলোর কয়েকটি: Blair B, King, The Blue Mutiny. (Philadelphia 1966); Chittabarata Palit, Tensions in Bengal Rural Society (Calcutta 1975); Report of the Indigo Commission (Calcutta 1860).

Leave a Comment

error: Content is protected !!