সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ হচ্ছে খাজনা বৃদ্ধি, মহাজনদের শোষণ ও কারচুপি

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ (ইংরেজি: Causes of Santhal Rebellion) নিহিত আছে খাজনা বৃদ্ধি, মহাজনদের শোষণ ও বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কারচুপির ভেতরে। ১৮৫০ এর দশকে  সুদখোর মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ ও ঠকবাজীতে সাঁওতাল জনগণ নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। মহাজনের ঋণ যতই ফেরৎ দিক, কখনও শোধ হতো না। বংশ পরম্পরায় পরিশোধ করতে হতো, ঋণ পরিশোধের নামে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সারাজীবন গোলাম করে রাখা হতো। পুলিশের সহায়তায় তারা সাঁওতালদের গরু-ছাগল কেড়ে নিতো, জমি কেড়ে নিতো, প্রতিবাদ করলে গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখতো। ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রতিকার চাইলে উল্টো অত্যাচারের খড়গ নেমে আসতো।

সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটার কারণ— “জমিদার, গোমস্তা, সরবরাহকার, পিয়োন ও মহাজন, পুলিশ, নায়েব, সাজোয়াল এবং আদালতের কর্মচারীগণ সবাই মিলে সাঁওতালদের উপর শোষণ, বলপূর্বক সম্পত্তি দখল, অপমান, প্রহার ও নানাভাবে উৎপীড়নের এক ভয়ংকর ব্যবস্থা পত্তন করেছে। ঋণের সুদ শতকরা ৫০ থেকে ৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। তাঁদের ঠকানোর জন্য ভুয়ো দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা দলে দলে সাঁওতাল অঞ্চলে ঢুকে ঋণের দায়ে সমস্ত শস্য টেনে বার করে নিয়ে যায়, এ দুঙ্কার্যে তাদের সহায় পুলিশ। পুলিশ-দারোগা কর্মচারীরাই এ অঞ্চলের প্রকৃত শাসক।”[২]

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় আদিবাসী জনগণের মধ্যে যারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিদ্যমান সমস্যার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তারা হচ্ছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। ১৮৫৫ সালে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তারা প্রচণ্ড প্রতিরোধ সংগঠিত করে, যে শাসন তাদের সংস্কৃতি ও নিজস্ব জীবনপ্রণালীর প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রতিরোধের বেশ কিছু কারণ নরহরি কবিরাজ যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছেন। কারণগুলো হলো—“মহাজনের নিপীড়ন, জমিদারের অত্যাচার, সরকারের বর্ধিত খাজনা আরোপ, ইউরোপীয় রেলওয়ের ঠিকাদার কর্তৃক বলপ্রয়োগে শ্রমিক খাটানো, মাঝি (manjhi) ও পরগনাইত (parganait)-এর অধিকার হ্রাসকরণ ইত্যাদি।”[৩]।

সাঁওতাল সমাজকাঠামোতে শাসক এলিট শ্রেণি ছিল মাঝি (manihi) নামে বংশগত শ্রেণি, যার পরে ছিল পরগনাইত বা পরগনাপ্রধানগণ। তাদের আধিপত্য আধুনিক রেল ব্যবস্থা, শ্রম ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়। উক্ত শাসক শ্রেণী অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবর্ণভুক্ত উপজাতিকে (ডোম, বাউরি, লোহার, গোয়াল ইত্যাদি) সাথে নিয়ে বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং বীরভূম জেলা ও ভাগলপুর সংলগ্ন পরগনাগুলোর উপর দরিদ্র মানুষের শাসন (poor man’s raj) প্রতিষ্ঠা করে।[৪]

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সাঁওতাল পরগনার ভাগনাডিহি গ্রামের মাঠের সেই ঐতিহাসিক গণসমাবেশের মাধ্যমে উত্থাপিত দাবিসমূহ বড় লাটকে জানানোর উদ্দেশ্যে হাজার হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষ সিধু-কানহুর নেতৃত্বে কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে পারগানা সাম টুডু প্রেরিত সংবাদ আসে যে জঙ্গিপুরের মহেশ দারোগা এলাকার অত্যাচারি সুদখোর মহাজন কেনারাম ভগত এর সহযোগিতায় ৬/৭ জন সাঁওতাল সামাজিক নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে ভাগলপুরে নিয়ে যাচ্ছে। পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহেশ দারোগা গংদের পথ রোধ করে সাঁওতাল সামাজিক নেতাদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়। এ সময় মহেশ দারোগা সিধু-কানহুকে আটক করতে উদ্যোত হলে সমবেত জনতা মহেশ দারোগা ও কেনারাম ভগতসহ তাদের দলের ১৯ জনকে সেখানেই হত্যা করে এবং ‘হুল’, ‘হুল,’ ‘হুলে হুল’ স্লোগান দেয়। হুল শুরু হয়। গোটা সাঁওতাল এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়।

বিদ্রোহী কণ্ঠে সিধু ও কানুসহ সব সাঁওতালরা শ্লোগান দেয়ঃ ‘আবুদ শান্তি বোন খজোয়া; জমিবুন হাতা ওয়া’; অর্থাৎ ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। মুক্তির সংগ্রাম-ধ্বনি ঘোষিত হয়, যথাঃ “রাজা-মহারাজাদের খতম করো”, “দিকুদের (বাঙালি মহাজনদের) গঙ্গা পার করে দাও”, “আমাদের নিজেদের হাতে শাসন চাই” প্রভৃতি।[৫] শ্রেণিসংগ্রাম ও বিদ্রোহের এমন ধ্বনি মুক্তির ইতিহাসে খুব সামান্যই আছে।

সাঁওতালদের অভিযানের গতিরোধের জন্য মেজর বারোজ বহু সৈন্য ও হাতি নিয়ে চেষ্টা করেন কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা লড়াইয়ের পর বেশ কিছু মৃতদেহ ফেলে রেখে পরাস্ত হয়ে পালাতে বাধ্য হন। এর পর বহু মহাজন ও গোমস্তাও নিহত হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহীরা পাকুড় অবরোধ করে। প্রাণরক্ষার জন্য ইংরেজ সৈন্য পাকুড় দুর্গে আশ্রয় নেয়। ১৮৫৫ সালের ১২ জুলাই সিধু ও কানু সাঁওতাল বাহিনী নিয়ে পাকুড়ের রাজবাড়ি দখল করেন। সেখান থেকে তাঁরা মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। ওদিকে বীরভূম জেলার প্রায় অর্ধেক এলাকায় ইংরেজ শাসন কার্যত লোপ পায়। সাঁওতাল মহা অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত মুহূর্তে বীরভূম থেকে বিহারের ভাগলপুর জেলা পর্যন্ত বিশাল এক ভূখণ্ডে ইংরেজ শাসন বিপর্যস্ত হয়।[৬]

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী বর্বর শাসক গোষ্ঠী এতদিন অশ্বারোহী, পদাতিক, হস্তীবাহিনী ও কামান নিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ইংরেজ শাসন রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। এবার ১৮৫৫ সালের ১০ নভেম্বর ইংরেজ সরকার সামরিক আইন জারি করে মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম থেকে বিহারের ভাগলপুর পর্যন্ত গোটা এলাকার শাসনভার সৈন্যবাহিনীর হাতে তুলে দিল।

হুল শুরু হবার পর তীর ধনুকে সজ্জিত সাঁওতাল নারী-পুরুষ যোদ্ধারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৮ মাস যুদ্ধ করে। কারণ তারা দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে চায়। এই গণযুদ্ধে দামিন-ই-কোহ্ অঞ্চলের সাঁওতাল ছাড়াও কামার-কুমার, তাঁতি, মুসলমান কৃষকসহ সর্বস্তরের শোষিত নির্যাতিত জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

তথ্যসূত্র

১. সিরাজুল ইসলাম, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহ”, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৫।
২. অনুপ সাদি, ২৯ জুন ২০১৩, সাঁওতাল বিদ্রোহ চলছে, গণমুক্তির লড়াই থামে নাই, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, লিংক https://www.roddure.com/history/santhal-rebellion-ongoing/.
৩. Narahari Kaviraj, “Peasant and Adhivası Uprisings”: Nishith Ranjan Ray et. al. (ed.).Challenge, 116. 
৪. সাঁওতাল বিদ্রোহের উপর পূর্ণাঙ্গ আলোচনার জন্য সর্বোকৃষ্ট উৎস হচ্ছে নরহরি কবিরাজ রচিত গ্রন্থ, The Sunthal Rebellion, Problems of National Liberanon. Voi IV, No. 1
৫. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭৭৯, ১১৪, ১১৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
৬. চিন্মোহন সেহানবীশ গণেশ ঘোষ ও অন্যান্য, মুক্তির সংগ্রামে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা দ্বিতীয় সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১০ পৃষ্ঠা ২০৩

Leave a Comment

error: Content is protected !!