কৃষক বিদ্রোহের কারণ (ইংরেজি: Causes of Peasant Movement) হচ্ছে ভারত ও বাংলা অঞ্চলে সতের ও আঠার শতকের ব্রিটিশ খাজনা ও শোষণ। বাংলা অঞ্চলের কৃষকের জীবনে কখনো প্রাচুর্য ছিল না। তারা কোনোমতো জীবন ধারণ করতে পারতেন। তবে, সেই অবস্থারও বিশাল পরিবর্তন হতে থাকে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ বণিক শ্রেণির আগ্রাসন বাংলার কৃষকের মুখের হাসি, তাদের বহুবিধ আনন্দ উৎসব কেড়ে নিতে থাকে। প্রথমে ইংরেজ বণিক ও আমলারা ধ্বংস করেছিল গ্রাম বাংলার কুটির শিল্প, পরবর্তীতে তাদের নজর পড়ে বাংলা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উর্বর ফসলি জমি ও বনভূমির উপর।
অতিরিক্ত মুনাফা আর অর্থের লোভে ভূমি রাজস্ব আদায়ে ইংরেজরা একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। যে পরীক্ষার নিষ্ঠুর বলি হয় বাংলার কৃষক আর সাধারণ রায়তেরা। তীব্র শোষণের ফলশ্রুতিতে অসহায় কৃষক সাধারণ মানুষের ধারাবাহিক বিদ্রোহ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এসব বিদ্রোহ ক্রমাগত চলতে থাকে আঠারো শতকের শেষাবধি থেকে উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত। এর সঙ্গে সঙ্গে সূত্রপাত ঘটে বাংলার মুসলমান সমাজে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের। যা পরবর্তী পর্যায়ে ব্যাপক কৃষক আন্দোলনে রূপ নেয়।
মুগলদের ছিল একটি প্রধানত কৃষিভিত্তিক সাম্রাজ্য এবং তার অধীনে ছিল প্রধান উৎপাদকগোষ্ঠী হিসেবে রায়তগণ, যারা রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতো। যদিও জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত কৃষি-উদ্বৃত্তের প্রায় সবটুকুই করের আকারে আদায় করা হতো, তথাপি রায়তদেরকে নিপীড়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ এবং অভাব অনটন থেকে নিস্তার লাভের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা ভোগের অনুমতি দেয়া হয়।
মুনাফা শিকারি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দুঃসময়ে খাজনা মওকুফ এবং টাকভী ঋণের মতো কোনো সুবিধা প্রদান ছাড়াই সকল কৃষকের উদ্বৃত্ত আদায়ে বদ্ধপরিকর ছিল। সরকারের ভূমিনীতি প্রজাদেরকে সরকারি প্রতিনিধি তথা ভূস্বামীদের শোষণের শিকারে পরিণত করে। যে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম পঞ্চায়েত প্রথাগতভাবে গ্রামে আইন-শৃঙ্খলা তদারক করতো, তার জন্য সরকারি সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। বিচ্ছিন্ন (alienated) গ্রাম সমাজ তখন অসহায়ভাবে রাষ্ট্র ও তার প্রতিনিধি, যেমন জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার, বানিয়া, ব্যবসায়ী, একচেটিয়া কারবারি, আমলা প্রভৃতির শোষণের শিকার হয়। কৃষক সমাজ বিভিন্ন সময়ে এদের বিরুদ্ধে এবং এদের মাধ্যমে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।[১]
কৃষক বিদ্রোহকে এর অন্তর্নিহিত কারণগুলোর প্রকৃতি অনুসারে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। কারণগুলো হচ্ছে: (১) কৃষকদের খাজনা ও অধিকার সংক্রান্ত নীতি বা প্রথা লঙ্ঘন; (২) প্রচলিত খাজনার হার অগ্রাহ্য করে যুক্তিহীনভাবে খাজনার হার বৃদ্ধিকরণ; এবং (৩) কৃষিশ্রম শোষণ। উপরোক্ত তিন পর্যায়ের বিদ্রোহ থেকে আমরা উদাহরণ হিসেবে মাত্র একটি (typical) কৃষক বিদ্রোহের উল্লেখ করবো।
তথ্যসূত্র
১. সিরাজুল ইসলাম, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহ”, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।