রাজমহলের যুদ্ধ হচ্ছে বাংলাকে পরাধীন করার অন্যতম নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ

রাজমহলের যুদ্ধ (ইংরেজি: The battle of Rajmahal) হচ্ছে বাংলায় দিল্লির আধিপত্য বিস্তার ও বাংলাকে পরাধীন করার অন্যতম নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ। ১২ জুলাই ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়ে বাংলা দিল্লির আধিপত্যবাদী মুগল শাসনের সূত্রপাত হয়। এই যুদ্ধ থেকেই বাংলাসহ গোটা পূর্বদেশ চারশ বছরের জন্য পরাধীন হয়ে যায়।

১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই তারিখে রাজমহলের যুদ্ধ থেকে বাংলার শেষ আফগান সুলতান দাউদ খান কররানী মুগলদের বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়।[১] এরই সঙ্গে বাংলার আফগান স্বাধীন সালতানাতেরও অবসান হয় এবং বাংলাদেশ, অন্তত কাগজে-কলমে, মুগল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। রাজধানী তাঁড়া[২] মুগলদের হস্তগত হয় এবং সেখানে মুগল সেনাপতি খান জাহান অবস্থান নেন। কিন্তু রাজধানী অধিকৃত হলেও সারা বাংলা মুগল আধিপত্য স্বীকার করে নি; বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আফগান সেনানায়কেরা ও বাংলার ভূঁইয়ারা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

দাউদ কররানীর দুইজন মন্ত্রী কতলু লোহানী এবং শ্রীহরি বিশ্বাসঘাতকতা করে দাউদ খানের চূড়ান্ত পরাজয়ের আগেই মুগল সেনাপতি খান জাহানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং রাজমহলের যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে দাউদের পতনে সাহায্য করে। পুরস্কারস্বরূপ কতলু লোহানী উড়িষ্যায় এবং শ্রীহরি যশোরে কয়েকটি পরগনা লাভ করে নির্বিঘ্নে শাসন করার সুযোগ পায়।[৩] এই দুইজন স্বপক্ষত্যাগী মুগল বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। পরে কতলু লোহানী উড়িষ্যায় মুগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং মাঝে মাঝে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও জীবনের শেষ পর্যন্ত মুগলদের শান্তিতে উড়িষ্যা দখলে রাখার সুযোগ দেয় নি।

শ্রীহরি আজীবন মুগলদের প্রতি অনুগত থাকে। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র প্রতাপাদিত্য প্রথমে মুগলদের অনুগত থাকে, কিন্তু জাহাঙ্গীরের আমলে ইসলাম খান চিশতী প্রতাপাদিত্যকে অন্যান্য বিদ্রোহ দমনে তাঁকে সাহায্য করতে আদেশ দিলে প্রতাপাদিত্য বিদ্রোহ করেন। প্রতাপাদিত্য এখন বুঝতে পারেন যে, মুগল শক্তি স্থায়ীভাবে বাংলা গ্রাস করবে। কিন্তু যুদ্ধে প্রতাপাদিত্য চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে আবার মুগল বশ্যতা স্বীকার করে নেন। উড়িষ্যা ও যশোর বাদ দিলে দাউদ কররানীর হত্যার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর মোবেলা করলে বাংলার ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লিখিত হতো, কিন্তু বিদ্রোহীরা বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই মুগলদের বিরুদ্ধাচরণ করে। সম্রাট আকবর একের পর এক সেনাপতি পাঠান, কিন্তু অনেক যুদ্ধ করেও তিনি সারা বাংলায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হন।[৪]

তথ্যসূত্র

১. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল), ২য় সংস্করণ, ঢাকা ১৯৮৭, ৩৮৩-৮৪। 
২. এটি মুসলিম ঐতিহাসিকদের তাড়া (Tanda)। সোলায়মান কররানী ১৫৬৪ সালে গৌড় থেকে রাজধানী তাড়ায় স্থানান্তর করেন। তাড়া গৌড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভাগীরথীর অপর পাড়ে অবস্থিত ছিল। প্রাচীন তাঁড়া নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
৩. কতলু লোহানীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা নিয়ামতুল্লাহর তারিখ-ই-খানজাহানি ওয়া মখজন-ই আফগানায় এবং শ্রীহরির বিশ্বাসঘাতকতার কথা রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্য চরিত্র গ্রন্থে পাওয়া যায়। Fintrats ara, “Katlu Lohani, Daud’s Commander-in-Chief, forming a reasonable connection with Khan Jahan, promised to take such a posture on the day of battle as to render Daud’s defeat unavoidable, on condition that some porganas should be settled on him” (Dorn, History of the Afghans. Vol 1, 183)
৪. সিরাজুল ইসলাম, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিদ্রোহ”, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!