ইতিহাস (ইংরেজি: History) হচ্ছে কোনো বস্তুর বিকাশের খোদ চেতনানিরপেক্ষ প্রক্রিয়া যা বাস্তবে স্থান ও কালে সংঘটিত হয়।[১] এক কথায় এটি হচ্ছে লিখিত নথিতে অতীতের বর্ণনা এবং উক্ত বর্ণনার অধ্যয়ন। এটা তুলে ধরে দেশ, জাতি বা প্রকৃতির বিভিন্ন যুগের সামাজিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনের সত্যনিষ্ঠ ধারাবাহিক বর্ণনা। মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত এই সব বর্ণনাই ইতিহাসের বিষয়বস্তু। ইতিহাস পাঠ করতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে ইতিহাস কী? জানতে হবে এর বিষয়বস্তু এবং পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে।
ইতিহাস হলো মানব সভ্যতা ও মানব সমাজের অগ্রগতির ধারাবাহিক সত্য নির্ভর বিবরণ। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠির উত্থান পতনের সত্যনিষ্ঠ বর্ণনা ইতিহাসের বিষয়বস্তু। গ্রিক পণ্ডিত হেরোডোটাস সর্বপ্রথম বিজ্ঞান সম্মতভাবে মানুষের অতীতের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে রচনার চেষ্টা করেছিলেন বলে তাকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। এটি পাঠ করে আমরা অতীতের অবস্থা জানতে পারি। আবার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎও গড়তে পারি। সর্বোপরি ইতিহাস পাঠ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদাবোধ এবং জাতীয়তাবোধেরও জন্ম দেয়। সে ক্ষেত্রে ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ একটি শাস্ত্র বা বিষয়।[২]
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ইতিহাস
‘ইতিহাস’ শব্দটির উৎপত্তি ‘ইতিহ’ শব্দ থেকে যার অর্থ ‘ঐতিহ্য’। ঐতিহ্য হচ্ছে অতীতের অভ্যাস, শিক্ষা, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি যা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত থাকে। এই ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয় এই ইতিহাস। ঐতিহাসিক ই.এইচ.কার-এর ভাষায়, এটা হলো বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ। ইতিহাস শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে এর রূপ দাঁড়ায়, ইতিহ+আস। যার অর্থ এমনই ছিল বা এরূপ ঘটেছিল। ঐতিহাসিক ড. জনসনও ঘটে যাওয়া ঘটনাকে ইতিহাস বলেছেন। তাঁর মতে, যা কিছু ঘটে তাই ইতিহাস। যা ঘটে না তা ইতিহাস নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সমাজ ও রাষ্ট্রে নিরন্তর বয়ে যাওয়া ঘটনা প্রবাহই ইতিহাস। গ্রিক শব্দ ‘হিস্টরিয়া’ (Historia) থেকে ইংরেজি ‘হিস্ট্রি’ (History) শব্দটির উৎপত্তি। যার বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ইতিহাস।
‘হিস্টরিয়া’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক) তিনি ‘ইতিহাসের জনক’ হিসেবে খ্যাত। তিনিই সর্বপ্রথম তার গবেষণা কর্মের নামকরণে এ শব্দটি ব্যবহার করেন যার আভিধানিক অর্থ হলো সত্যানুসন্ধান বা গবেষণা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইতিহাস হলো যা সত্যিকার অর্থে ছিল বা সংঘটিত হয়েছিল তা অনুসন্ধান করা ও লেখা। তিনি তাঁর গবেষণায় গ্রিস ও পারস্যের (বর্তমানে ইরান) মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধান করেছেন। এতে তিনি প্রাপ্ত তথ্য, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ এবং গ্রিসের বিজয়গাথা লিপিবদ্ধ করেছেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম এ ঘটনা ভুলে না যায়। এ বিবরণ যাতে তাদের উৎসাহিত করে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। হেরোডোটাসই প্রথম ইতিহাস এবং অনুসন্ধান – এ দুটি ধারণাকে সংযুক্ত করেন। ফলে ইতিহাস পরিণত হয় বিজ্ঞানে; পরিপূর্ণভাবে হয়ে ওঠে তথ্য নির্ভর এবং গবেষণার বিষয়।
ইতিহাসবিদ টয়েনবির মতে, সমাজের জীবনই ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে মানব সমাজের অনন্ত ঘটনা প্রবাহই হলো ইতিহাস। আবার র্যাপসন বলেছেন, ইতিহাস হলো ঘটনার বৈজ্ঞানিক এবং ধারাবাহিক বর্ণনা। আধুনিক ইতিহাসের জনক জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন র্যাংকে মনে করেন, প্রকৃত পক্ষে যা ঘটেছিল তার অনুসন্ধান ও তার সত্য বিবরণই ইতিহাস। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ইতিহাস হলো মানব সমাজের অতীত কার্যাবলির বিবরণ। সুতরাং সাধারণভাবে বলতে গেলে, ইতিহাস হচ্ছে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিক ও সত্যনিষ্ঠ বিবরণ। সঠিক ইতিহাস সব সময় সত্যকে নির্ভর করে রচিত।
ইতিহাসের বিষয়বস্তু
মানব সমাজ ও সভ্যতার ধারাবাহিক পরিবর্তনের প্রামাণ্য ও লিখিত দলিল হলো ইতিহাস। ইতিহাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিকো (Vico) মনে করেন যে, মানব সমাজ ও মানবীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপত্তি ও বিকাশ হচ্ছে ইতিহাসের বিষয়বস্তু। মানব জীবনের গতিধারা সৃষ্টির শুরু থেকে যা কিছু ঘটেছে, সব কিছুই ইতিহাস। কিন্তু ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা ইতিহাসে স্থান পায় না, বরং যে সব ঘটনা বা বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, তাই সাধারণত ইতিহাসে স্থান পায়। এসব ঘটনাই ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
ইতিহাস শুধু ঘটনার সমষ্টি নয়, ঘটনার অন্তরালে থাকা পরিস্থিতির বিশ্লেষণও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাসের অন্যতম বিষয়বস্তু হলো মানব সমাজ, সভ্যতা বিকাশের ধারাবিবরণী। অর্থাৎ মানুষের আদিম সভ্যতা ও তার ক্রমবিকাশ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। এক সময় মানুষ ছিল গুহাবাসী। তার জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল শিকার, মাছধরা, ফলমূল সংগ্রহ। এরপর ধীরে ধীরে তার জীবিকার ধরণ বদলাতে থাকে। এক সময় যাযাবর মানুষ কৃষিজীবী মানুষে পরিণত হয়। এক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কৃষি সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে নগরসভ্যতা। এসব পরিবর্তনের বিবরণ ইতিহাসের বিষয়বস্তু। মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যা মানব সমাজ-সভ্যতার উন্নতি ও অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে তা সবই ইতিহাস ভুক্ত বিষয়। যেমন- শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, স্থাপত্য, রাজনীতি, যুদ্ধ, ধর্ম আইন – প্রভৃতি বিষয় সামগ্রিকভাবে যা কিছু সমাজ-সভ্যতা বিকাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে তাই ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা
মানব সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের সত্য নির্ভর বিবরণ হচ্ছে ইতিহাস। যে কারণে জ্ঞানচর্চার শাখা হিসেবে ইতিহাসের গুরুত্ব অসীম। এটা পাঠ মানুষকে অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অবস্থা বুঝতে, ভবিষ্যৎ অনুধাবন করতে সাহায্য করে। ইতিহাস পাঠের ফলে মানুষের পক্ষে নিজের ও নিজ দেশ সম্পর্কে মঙ্গল-অমঙ্গলের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব। সুতরাং দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং ব্যক্তির প্রয়োজনে এই বিষয় পাঠ অত্যন্ত জরুরি। অতীতের সত্যনিষ্ঠ বর্ণনা মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। আর এ বিবরণ যদি হয় নিজ দেশ জাতির সফল সংগ্রাম, গৌরবময় ঐতিহ্যের তাহলে তা মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। একই সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে। সে ক্ষেত্রে জাতীয়তাবোধ, জাতীয় সংহতি সুদৃঢ়করণে ইতিহাস পাঠের বিকল্প নেই। ইতিহাস জ্ঞান মানুষকে সচেতন করে তোলে। বিভিন্ন মানবগোষ্ঠির উত্থান-পতন এবং সভ্যতার বিকাশ ও পতনের কারণগুলো জানতে পারলে মানুষ ভালো মন্দের পার্থক্যটা সহজেই বুঝতে পারে। ফলে সে তার কর্মের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন থাকে।
ইতিহাসের ব্যবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ এটা পাঠ করে অতীত ঘটনাবলির দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ইতিহাসের শিক্ষা বর্তমানের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যেতে পারে। ইতিহাস দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষা দেয় বলে একে বলা হয় শিক্ষনীয় দর্শন। মানুষ কৌতুহলপ্রিয়। মানুষ তার অতীত ঘটনা জানতে চায়। তাই এটি পাঠ করার মাধ্যমেই অতীতকে জানা সম্ভব। সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস পাঠ করে যে জ্ঞান লাভ হয়, তা বাস্তব জীবনে চলার জন্য উৎকৃষ্টতম শিক্ষা। এই বিষয় পাঠ করলে বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা বাড়ে, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সাহায্য করে। ফলে জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহ জন্মে।
তথ্যসূত্র
১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১২।
২. অনুপ সাদি, ১৫ আগস্ট ২০১৯, “ইতিহাস হচ্ছে কোনো বস্তুর বিকাশের চেতনানিরপেক্ষ প্রক্রিয়া যা বাস্তবের স্থান কালে সংঘটিত ও তদনুসারে লিখিত”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা; ইউআরএল: https://www.roddure.com/history/on-history/
রচনাকাল: ১৪ আগস্ট ২০১৯, কুরপাড়, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।