চীনের আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের ইতিহাস (ইংরেজি: History of the Primitive clan Society of China) হচ্ছে আনুমানিক নব্য প্রস্তর যুগের আরম্ভ থেকে বা প্রায় ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে লৌহ যুগের শুরু পর্যন্ত। উল্লেখ করা হয়, বস্তুনির্ভর সংস্কৃতিকে অনেক উঁচুস্তরে নিয়ে যাওয়া প্রাথমিক জাতিগুলোর মধ্যে তারা অন্যতম। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে চীনের জনগণ লোহার ব্যবহার দেরিতে শুরু করে।[১]
চীনের ইতিহাস বলতেই আসে, বহুজাতিক চীন ছিল মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান। ধরে নেওয়া হয় যে, বহুদিন ধরে আটটি কৌণিক সংস্কৃতির ধারা এসে তৈরি করেছিল চীনা সংস্কৃতি। (ক) এদের মধ্যে একটি ছিল হোপেই (বেজিং-এর চারপাশ), শান্টুং এবং দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়ার উত্তর-পূবালি সংস্কৃতি। আদি সাইবেরীয় গোষ্ঠীজাত এই সংস্কৃতির ধারকরা ‘শিকারী’ থেকে বুনিয়াদী ‘কৃষকে’ উন্নীত হয়েছিল। (খ) এরই পশ্চিমে ছিল শানসি ও অন্তর্মঙ্গোলিয়ার জেহল প্রদেশের উত্তুরে সংস্কৃতি। এখানকার মোঙ্গল জাতির মানুষ ছিল যাযাবর পশুপালক। (গ) আরও পশ্চিমে আদিম তুর্কিরা শেনসি আর কাংসু প্রদেশে গড়ে তুলেছিল উত্তর-পশ্চিম সংস্কৃতি। তারা কৃষিকাজ জানত, ভেড়া ও ছাগল পালন করত, ঘোড়াকেও তারা পোষ মানিয়েছিল। (ঘ) পশ্চিমের সেঝুয়ান এবং কাংসু-শেনসি-র পার্বত্য অঞ্চলে থাকতে তিব্বতিরা। তারা ছিল প্রধানত মেষপালক। এই চারটি সংস্কৃতি ছাড়া দক্ষিণে ছিল চার ধরনের সংস্কৃতি। সেগুলো হলো অস্ট্রো-এশিয়াটিক লিয়াও সংস্কৃতি, কোয়াংটুং এবং কোয়াংসির থাইঘেঁষা ইয়াও সংস্কৃতি, আদি থাই সংস্কৃতি এবং ইয়াও ও থাই-এর সম্পূর্ণ মিশ্রণের পর নতুন আর একটি মিশ্র সংস্কৃতি। দক্ষিণের এই সংস্কৃতিগুলো মূলত ছিল কৃষিমুখী।[২]
ওলফার্ম এবারহার্ড-এর (Wolfram Eberhard) মতে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই আটটি ধারাকে পৃথক পৃথকভাবে চেনা যেত। কিন্তু এর এক শতকের মধ্যেই পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই সংস্কৃতিগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশে যায় এবং শেষ পর্যন্ত দুটো প্রধান চৈনিক সংস্কৃতি-চেতনা গড়ে ওঠে। পূর্বে লুং শান (Lung Shan) ও পশ্চিমে ইয়াং-শাও (Yang Shao)।
লুং শান সংস্কৃতির মানুষরা কৃষিকাজে উন্নত ছিল, তাদের স্থায়ী কৃষিজমি ছিল, স্তরবিন্যাস্ত সমাজভিত্তিক গ্রামগুলো মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা থাকত এবং তারা চাকা ঘুরিয়ে চমৎকার কালো মৃৎপাত্র তৈরি করত।
ইয়াং-শাও গ্রামগুলো তুলনায় ছিল অস্থায়ী। তবে তারাও সুন্দর সুন্দর পাথুরে হাতিয়ার (কাস্তে, কোদাল) ব্যবহার করে কৃষির উন্নতি ঘটিয়েছিল। ভেড়া ও ছাগল ছাড়াও তারা শূয়োর ও কুকুর পালন করত। লাল, কালো ও সাদা—এই তেরঙ্গা মৃৎপাত্র তারা বানাতে জানত। রেশমের ব্যবহারও তারা আবিষ্কার করেছিল বলে জানায়।
প্রথম সংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাও এই ইয়াং-শাও-এর হেনান অঞ্চলেই গড়ে ওঠে বলে মনে করা হয়। সম্ভবত ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় এবং ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তা বিস্তৃত অঞ্চলে ২২০৫ অব্দে ই-উ (Yii) এখানে সিয়া (Hsia) রাষ্ট্রের পত্তন করেন। এই বংশের শাসন স্থায়ী হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭২৫ মতান্তরে ১৭৬৬ অব্দ পর্যন্ত। এই পর্বের চীনে সামন্ততন্ত্র ছিল না। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সমাজের ভিত্তি ছিল পিতৃতান্ত্রিক পরিবার।
শাং রাজত্বের আমলের আরম্ভকে চীনের আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের ইতিহাস শেষ হয়েছে ধরা হয়। কারণ, সে সময় থেকেই যুদ্ধবন্দিদের দাস হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ থেকেই দাসের ব্যবহার শুরু হয় বলা যায়। বসন্ত এবং শরত কালের রাজত্বকালে, যে রাজত্ব ৭৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয়, চীনে লোহার ব্যবহার শুরু হয়।
আলোকচিত্রের ইতিহাস: হেমুডু সংস্কৃতিতে নির্মিত মৃৎশিল্পের নিদর্শন, ৫৫০০-৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ কালের, আলোকচিত্র Siyuwj.
তথ্যসূত্র
১. ইজরাইল এপস্টাইন, আফিম যুদ্ধ থেকে মুক্তি, মাহফুজ উল্লাহ অনূদিত, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পেইচিং, প্রথম সংস্করণ ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ১-২।
২. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ১-৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।