তাওবাদ বা তাও ধর্ম (ইংরেজি: Taoism) হচ্ছে প্রাচীন চীনের দর্শনের একটি মৌলিক সূত্র। কনফুসীয় ধর্মের মতো তাওধর্মও চীনের একটি দেশীয় ধর্ম। চীনা জনগণের তিনটি বড় ধর্ম হচ্ছে কনফুসীয় ধর্ম, তাও ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্ম ভারত থেকে চীনা অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তাও বলতে স্বভাব, প্রকৃতি এবং পরবর্তীকালে প্রাকৃতিক বিধান বুঝাত। একে নীতির সূত্র বা আদর্শ হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। চীনের দর্শনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘তাও’ সূত্রের অর্থেরও বিকাশ ঘটেছে। চীনের ভাববাদী দার্শনিকগণ ‘তাও’ কে একটি ভাববাদী সূত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, আবার লাওজু, সুনজু, ওয়াংচাং প্রমুখ বস্তুবাদী দার্শনিক তাওকে বস্তুর প্রকৃতি এবং বস্তুর পরিবর্তনের নিয়ম বা বিধান বলে ব্যাখ্যা করেছেন।[১]
১৯২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ের এক হিসেবে পৃথিবীতে তাও ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ, এবং ২০১০ সালের এক জরিপে এই ধর্মের অনুসারী সংখ্যা ১ কোটি বিশ লাখ। তবে চীনের ধার্মিক লোক একই সংগে তিনটি ধর্মই অনুসরণ করে। ১৯৪৯ সালের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে তিনটি ধর্মের প্রভাব চিনে সমভাবে থাকলেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরে চীনে ধর্মীয় প্রভাব দুই তৃতীয়াংশ বিলুপ্ত হয়েছে। তবু একথা বলা চলে যে তাও মতামত গত ২০০০ বছর ধরে চীনের জনগণের চিন্তা চেতনা বিশ্বাস ও সংস্কৃতির উপর ব্যাপক প্রভাবশালী।[২]
কনফুসীয় নীতিবিদ্যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরই সমসাময়িক কিন্তু অগ্রজ লাওজু (Lao-tzu) বা লাওৎসির (Lao-tse) তাওবাদ বা তাও চিন্তাধারা। তাও কথাটির অর্থ পথ। কিন্তু কনফুসিয়াস সাধারণ মানুষকে দৈনন্দিন সমাজজীবনের সুস্থতার পথ দেখিয়েছিলেন, আর লাওজু দেখিয়েছিলেন বুদ্ধিচর্চার পথ, ব্রহ্মবাদী নিষ্কাম কর্মযোগের পথ, যে পথ ধরলে মানুষ ধৈর্য, বিনয়, প্রজ্ঞা, প্রেম, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি সদগুণের অধিকারী হতে পারে। রাজার দেশ শাসনের ক্ষেত্রেও লাওজু হস্তক্ষেপ বিনা দেশ শাসন বা নিঃস্বার্থ প্রজাপালনের কথা বলেছিলেন, যা আসলে ছিল অবাস্তব। অবাস্তব এবং সহজবুদ্ধিগ্রাহ্য নয় বলেই তাও-শিক্ষা বা লাওজু-র শিষ্য চুয়াং-সু (Chuang-tzu)-র ব্যাখ্যা, এবং তাওশিক্ষার দুটো বই তাও এবং তি, একত্রে তাও-তে চিং (Tao-Te-Ching) সাধারণের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় হয়নি।[৩]
তথ্যসূত্র
১. সরদার ফজলুল করিম, দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা, ৫ম সংস্করণ জুলাই, ২০০৬, পৃষ্ঠা ৩৭১।
২. মো. আবদুল ওদুদ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমাজ ও রাষ্ট্রের দার্শনিক চিন্তা, মনন পাবলিকেশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৪ এপ্রিল ২০০৮, পৃষ্ঠা ৬১৩।
৩. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ১১।
রচনাকাল: ৮ এপ্রিল ২০২১, এসজিআর।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।