লং মার্চ বা দীর্ঘ যাত্রা ছিল একটি সামরিক পশ্চাদপসরণ যা লাল ফৌজ নিয়েছিল

লং মার্চ বা দীর্ঘ যাত্রা (ইংরেজি: The Long March) ছিল একটি সামরিক পশ্চাদপসরণ যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (CCP) লাল ফৌজ সম্পন্ন করেছিল। এই দীর্ঘ যাত্রা কুয়োমিনতাঙের তাড়া এড়াতে লাল ফৌজ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। উল্লেখ করা যায়, লাল ফৌজ ছিল গণমুক্তি ফৌজের অগ্রদূত। দৃঢ়ভাবে বলতে গেলে, লং মার্চ ছিল একটি ধারাবাহিক পদযাত্রা, কারণ দক্ষিণের বিভিন্ন কমিউনিস্ট সেনাবাহিনী উত্তর ও পশ্চিমে পালিয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, সর্বাধিক বিখ্যাতটি জিয়াংসি প্রদেশে ১৯৩৪ সালের অক্টোবরে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৩৫ সালের অক্টোবরে শানসি প্রদেশে শেষ হয়েছিল।

১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় লাল ফৌজ কিআংসি প্রদেশের ঘাঁটি থেকে সরে আসে। তারপর শুরু হয় লং মার্চ। বিশ্বের ইতিহাসে লং মার্চ অভূতপূর্ব অভিযান কাহিনি। বিভিন্ন স্থানে লালফৌজের অনেক ঘাঁটি ছিল। বেশ কিছু ঘাঁটি ত্যাগ করে লালফৌজ যোগ দেয় লং মার্চ-এ। প্রাকৃতিক বাধা বিপত্তি এবং সামরিক ও রাজনৈতিক সংকট অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় লাল ফৌজ উত্তর শেনসি পৌছোয় ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে। কেন্দ্রীয় লাল ফৌজ যোগ দেয় উত্তর শেনসির লাল ফৌজ ইউনিটের সঙ্গে। 

ডন পি ষড় এবং হোলং-এর নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজের ইউনিট এবং শ্যুই শি আং চিএন নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজের ইউনিট ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে শেনসি-কানসু অঞ্চলে কেন্দ্রীয় লাল ফৌজের সঙ্গে যোগ দেয়। সুদীর্ঘ যাত্রায় পঁচিশ হাজার লি (আট হাজারেরও বেশি মাইল) অতিক্রম করেছিল লাল ফৌজ। এগারোটি প্রদেশের মধ্য দিয়ে লাল ফৌজের অভিযান এগিয়েছে। প্রদেশগুলি হলো ফুকিএন, কিআংসি, কোআনতুং, হুনান, কোআংসি, কুইচৌ, সেচুআন, য়ুনান, সিকাং,কানসু ও শেনসি। মোট দুশো মিলিয়ন জনসংখ্যা ছিল এগারোটি প্রদেশে।

মাও সেতুংয়ের মূল লক্ষ্য ছিল শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, পাতি-বুর্জোয়া এবং জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে সংহতি সাধন। সংহতিকে ভিত্তি করেই তিনি গঠন করতে চেয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ জাতীয় বিপ্লবী ফ্রন্ট। শুধুমাত্র শ্রমিক ও কৃষকদের নিয়ে গঠিত প্রজাতন্ত্র নয়। গণপ্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই তার কাম্য লক্ষ্য ছিল। ১৯৩৬ সালে শেনসি প্রদেশের পাও-আন অঞ্চলে মাও সেতুংয়ের বিশ্বাস যান্ত্রিক বিশ্বাস নয়। প্রকৃত কমিউনিস্টকে নিরন্তর অনুশীলন করতে হবে চারিত্রিক গুণাবলি। নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম, অনির্বাণ দেশপ্রেম, দুর্জয় সাহস, দুর্নিবার আশা, ধ্রুব প্রত্যয় প্রভৃতি চারিত্রিক গুণাবলি কমিউনিস্টরা নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অনুশীলন করেছিলেন। লং মার্চ-এ যারা সহযাত্রী ও সহযোদ্ধা ছিলেন, তাদের চরিত্রে অল্পবিস্তর এই সব গুণের বিকাশ ঘটেছিল। সুস্থ সুন্দর সমাজগঠনে এই গুণাবলির নিরন্তর অনুশীলন অপরিহার্য এবং অনুকরণীয় উত্তরাধিকাররূপে স্বীকৃত।

বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে। দেওয়াল লিখনে এই কথা কয়টি অভিব্যক্ত। এটি নিছক দলীয় স্লোগান নয়। চিনের বিশেষ পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক সত্য। কেন্দ্রীয় শক্তি লুপ্তপ্রায়। দেশ জুড়ে অশান্তি ও অরাজকতা। এই পরিস্থিতিতে সামরিক শক্তি যে দল নিয়ন্ত্রণ করবে, তার হাতেই থাকবে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাগাম ও চাবুক। কমিউনিস্টরা এই নীতিকে প্রতি পদক্ষেপে কাজে লাগিয়েছে। এ নীতি এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

ইয়েনান-এ কমিউনিস্টরা শ্রেণিসংগ্রামের স্লোগানে মাতোয়ারা হয়নি। বৃহত্তর গণসমর্থন লাভের প্রত্যাশায় কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারে তারা ব্রতী হয়েছিল। ভূমিসংস্কার কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপুল কৃষক শ্রেণির সমর্থন লাভ। জাপান এবং কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা গেরিলা সংগঠন গড়ে তুলেছে। তখনও মানবতাবাদী হিসাবে তারা কৃষক শ্রেণির মানমর্যাদাকে সমাদর করেছে। চিনের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম কৃষকরা কমিউনিস্টদের কাছ থেকে পেয়েছে দরদি মানুষের প্রাণভরা ভালোবাসা।

১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় লালফৌজ উত্তর শেনসির লাল ফৌজ ইউনিট এবং হুপে-হোনান-আনউএই সীমান্ত অঞ্চল থেকে উত্তরমুখী যাত্রা করেছিল যে লালফৌজ ইউনিট-এইসব লালফৌজ বাহিনী যৌথভাবে পরাজিত করে কুয়োমিনতাং সেনার তৃতীয় ঘেরাও অভিযান। কিছুদিন পর জাপানি সাম্রাজ্যবাদ পুনরায় উত্তর চিনে আক্রমণ শুরু করে। ১৯৩৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পিকিং-এ চিনের ছাত্রসমাজ জাপানকে-রুখতে-হবে-চিন-বাঁচাও আন্দোলন শুরু করে এবং সংগঠিত করে সভাসমিতি শোভাযাত্রা। ছাত্র-আন্দোলন সমগ্র চিনে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় কমিউনিস্ট পার্টিরও স্লোগান ছিল “গৃহযুদ্ধ বন্ধ করো, জাপানকে রুখতে এক হও।” বিপ্লবের তরঙ্গ তখন বেগবান।

ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান, জানায়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৩৫ সালের আগস্ট চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করে একটি ঘোষণাপত্র জারি করে। ১৯৩৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরো এ বিষয়ে অনুমোদন জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কর্মীদের সম্মেলনে মাও সেতুং The Policy of Fighting Japanese Imperialism শিরোনামে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। ওই প্রতিবেদনে মাও দলের নীতি বিশ্লেষণ করে লেখেন:

The task before the party is to integrate the activities of the Red Army with all the activities of the workers, peasants, students, the petty bourgeoisie and the national bourgeoisie of the whole country and to form out of this integration a united national revolutionary front. 

লাল ফৌজ, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, পাতি-বুর্জোয়া এবং জাতীয় বুর্জোয়ার কার্যাবলিকে সমগ্র দেশব্যাপী সুসংহত করে একটি ঐক্যবদ্ধ, জাতীয় বিপ্লবী ফ্রন্ট গঠনের সুস্পষ্ট নীতি মাও ঘোষণা করেছিলেন ওই প্রতিবেদনে। মাও ব্যাখ্যা করেছেন ১৯২৪-২৭ কালপর্বে পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূল। ১৯২৭ সালের পর পরিস্থিতি পালটে গেছে। পরিবর্তন গুণগত। কমিউনিস্ট পার্টি শক্তিশালী। লাল ফৌজ প্রবল পরাক্রান্ত। শুধু তাই নয়, লাল ফৌজের শক্ত ঘাঁটি ছিল দেশজুড়ে। কমিউনিস্ট এবং লাল ফৌজের উদ্যোগে গঠিত জাপান-বিরোধী ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট জাতীয় ফ্রন্টই হবে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অমোঘ অস্ত্র।

তথ্যসূত্র

১. জহর সেন, এ যুগের চিনকথা, মিত্রম, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা ২৪৩-২৪৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!