চীনে শ্রেণিসংগ্রাম প্রকাশিত হয়েছে শোষক ও নির্যাতকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রূপে

চীনে শ্রেণিসংগ্রাম বা চীনে শ্রেণিসংগ্রামের রূপ (ইংরেজি: Class struggle in China) প্রকাশিত হয়েছে দাসমালিক, জেন্ট্রি, রাজতন্ত্র, আমলাতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদসহ বিভিন্ন শোষক ও নির্যাতকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বহুবিধ ধরনে।

সামন্তযুগে চীনে শ্রেণিসংগ্রাম

জেন্ট্রি ও কৃষক: সামাজিক দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তন

নীতিনিষ্ঠ ধর্মপথের পথিক ঐতিহ্য গর্বিত চীনের সামাজিক ইতিহাসে পরিবর্তন আসত খুবই ধীরে। সামাজিক টানাপোড়েন যেহেতু তেমন স্পষ্ট ছিল না, পরিবর্তনের লক্ষণও তাই ছিল অস্পষ্ট। একমাত্র খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের পর থেকে সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সম্পর্কজনিত উত্তেজনা দেখা দেয়, পরিবর্তনের লক্ষণও তাই তখন থেকেই কিছুটা স্পষ্ট হতে থাকে। এই সময়েই চীনা সমাজে দুটো শ্রেণি পরস্পরবিরোধী ভূমিকায় আগের চাইতে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। শ্রেণি দুটো হলো উচ্চবিত্ত ভূ-কেন্দ্রিক ভদ্রলোক শ্রেণি বা জেন্ট্রি (Gentry) এবং কৃষক শ্রেণি।

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে একদিকে যখন লোহার ব্যবহার ও খনি শিল্পের প্রসার সামন্তপ্রভুদের হাতে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খুলে দেয়, অন্যদিকে তেমনি প্রয়োজন হয় সমাজ ও উৎপাদন কাঠামোর অধিকতর নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পেশাদার প্রশাসক শ্রেণির। এই শ্রেণিটিই হলো জেন্ট্রি, যাদের বিদ্বৎ শ্রেণিও (Scholarliterati) বলা যায়। ধ্রুপদী চীনা শিক্ষাব্যবস্থার স্নাতক এই পণ্ডিত রাজকর্মচারীরা ক্ষমতা ও জমি এই দুই-এরই অধিকারী ছিলেন।

ইউরোপের জেন্ট্রির সঙ্গে এদের পার্থক্য ছিল। ইউরোপের জেন্ট্রি অর্থনৈতিক ক্ষমতাবলে রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অর্জন করতেন, আর চীনা জেন্ট্রি রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে, প্রশাসনিক পদাধিকারে ভূম্যধিকার পেতেন। ঐতিহাসিক জাঁ শেনো বলেছেন, পণ্ডিত রাজকর্মচারীরা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন চীনের শাসক শ্রেণির অংশ। চৈনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাদের প্রভাব এত বেশি ছিল যে, অনেকে তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রকে “Gentry State” আখ্যা দিয়েছেন। জেন্ট্রির ক্ষেত্রে ভূম্যধিকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর রাজনৈতিক ক্ষমতার চমৎকার সমন্বয়কে অধ্যাপক যোসেফ নিডহাম ‘Bureaucratic Feudalism’ বা ‘আমলাতান্ত্রিক সামন্তবাদ’ বিশেষণে ভূষিত করেছেন।

অন্যদিকে জেন্ট্রির প্রতিপত্তি যত বেড়েছিল, তত খারাপ হয়েছিল কৃষকের অবস্থা। বহু কৃষকের নিজস্ব জমি ছিল না। তারা ভাড়াটে চাষি হিসেবে বেশি কর দিয়ে জেন্ট্রির তত্ত্বাবধানে জমি চাষ করত। অর্থ ও ফসল—দুই উপায়েই জমিদারের পাওনা মেটাতে হতো। তার ওপরে ছিল বেগার খাটা। চিং তিয়েন পদ্ধতি[১] অনুসারে যে কৃষকদের জমি দেওয়া হয়েছিল, তাদেরও জেন্ট্রি জমিদারদের কাছে সব সময়েই কর জোড়ে থাকতে হতো। চাষের সরঞ্জাম কেনার জন্য, বীজধানের জন্য, বাড়তি করের জন্য তাদের ঋণ নিতে হতো। জেন্ট্রি জমিদাররাই ছিলেন মহাজন। তাঁরা স্থানীয় মোড়ল বা ম্যান্ডারিনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। ম্যান্ডারিন, পুলিশ ও আদালতের সাহায্যে কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতেন এই জেন্ট্রি সদস্যরা।

জেন্ট্রি ও কৃষক—এই দুই শ্রেণির বিপরীত সম্পর্ক মাঝে মাঝেই সামাজিক উত্তেজনার সৃষ্টি করত। ঘটত কৃষক বিদ্রোহ। তৎকালীন চীনা সমাজে কৃষকরাই ছিল একমাত্র বিপ্লবী শ্রেণি। কারিগর, দিনমজুর, মাঝি, কুলি, ফেরিওয়ালা—এদের সঙ্গে নিয়ে কৃষকরা গোপন সমিতি গড়ে তুলত এবং জেন্ট্রির অত্যাচার অসহ্য হয়ে উঠলে গণবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিত। মাও-সে-তুং তাঁর চীন-বিপ্লব ও চীনা বিপ্লব ও চীনা কমিউনিস্ট দল সম্পর্কিত বইয়ে নির্দিষ্টভাবে ১৭টি গ্রাম বিদ্রোহের এবং ২০০০-এর বেশি বছর ধরে ব্যাপ্ত ছোট-বড় অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “চীনে কৃষকবিদ্রোহ এবং কৃষক যুদ্ধের ব্যাপক ব্যাপ্তি পৃথিবীতে নজিরবিহীন এবং চীনা সামন্তসমাজে কৃষকই সত্যকার চালিকা শক্তি গঠন করেছে।”

কিন্তু তবুও দীর্ঘকাল, এমনকি উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চীনা সমাজের বস্তুগত পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। কারণ এই কৃষক বিদ্রোহগুলো এক জোট হয়ে শ্রেণিসংগ্রামে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। চীনা সামন্তবাদও তাই পরাজিত হয়নি।[২]

মাও পরবর্তী চীনে শ্রেণিসংগ্রাম

চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পরপরই চীনে একটি জোরালো শ্রেণি সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। কোন রাস্তা অনুসরণ করতে হবে? সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের অধীনে ক্রমাগত বিপ্লবের রাস্তা, মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দ্বারা উন্মুক্ত করা রাস্তা অথবা পুঁজিবাদী পুনরুদ্ধারের পথ অনুসরণ করার রাস্তা। এই ইস্যুতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুং চিন্তাধারার ব্যানারকে উঁচু করে রাখা হবে নাকি ধুলোয় নিক্ষেপ করা হবে তা নিয়ে দীর্ঘ লড়াই চলেছিল।

চীনে এই শ্রেণিসংগ্রাম চলেছিল, কারণ সেখানে এর সামাজিক ভিত্তি বিদ্যমান আছে। সেখানে উৎখাতকৃত জমিদার শ্রেণীর অবশিষ্টাংশ ছিল এবং নতুন বুর্জোয়ারা আছে। আন্তর্জাতিকভাবে আছে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদ এবং আধুনিক সংশোধনবাদ। এই সামাজিক শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা সর্বহারা শ্রেণীর সাথে শক্তির বিচার করার জন্য বারবার চেষ্টা করবে। তারা সকল প্রতিক্রিয়াশীলদের পথ অনুসরণ করবে। দীর্ঘ প্রায় এক দশকের লড়াইয়ের পর ১৯৯০-৯১ সালের ভেতরে দেং জিয়াও পিং ও অন্যান্য পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী নেতাদের পথ ধরে চীনে পুনরায় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র ও টিকা

[১] এই পদ্ধতিতে নিজেদের জন্য জমি চাষ করা ছাড়াও সরকারি খাস জমিতে কৃষকদের শ্রম দিতে হত।
২. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ১১-১২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!