পুরনো চীনের অর্থনীতি, (ইংরেজি: The Economy of Ancient China) সেই সময়ের সমস্ত অর্থনীতির মতো (যা শিকারী-সংগ্রাহকের পর্যায় অতিক্রম করেছিল) কৃষিভিত্তিক ছিল। চীনা পরিবারের অধিকাংশই ছোট কৃষি গ্রামে বাস করত, এবং একেকটি গ্রামে এক ডজন বা তার বেশি পরিবার থাকত।
পৌরাণিক সূত্র অনুসারে, দশ হাজার বছরেরও অনেক আগে সম্রাট শেন মুং চীনাদের ভূমি কর্ষণ শিখিয়েছিলেন। তারপর থেকে প্রতি বসন্তে রাজা নিজে প্রজাদের সামনে হাল চালনা করে হাল কর্ষণ উৎসবের সূচনা করতেন। পেইপিং বা বেইজিং-এর কৃষিমন্দিরে উৎসব হতো, একে বলা হতো ‘শিয়েন নুং তান্’।
চীনে বরাবরই কৃষিকাজকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। একটা প্রবাদই ছিল এইরকম : “যদি একটিমাত্র লোকও চাষ না করে, তবে কেউ না কেউ ক্ষুধায় কষ্ট পাবে।” এমনকি ‘শী তাই ফু’ বা রাজ কর্মচারীরাও অবসর নেওয়ার পর চাষের কাজে লেগে যেতেন। প্রাচীন চীনা সাহিত্য এ বিষয়ে সুন্দর সুন্দর কবিতা আছে। মহামুনি মেনশিয়াস লিখে গেছেন, “বসন্তকালে রাজা চাষের কাজ পরিদর্শন করে ঘাটতি শস্যের বীজ দান করতেন; শরৎকালে ধান উৎপাদন পরিদর্শন করে তিনি ঘাটতি শস্যের মূল্য দিতেন।” দেশপ্রেমিক কুয়ান সু-র কথায়, “কৃষিপ্রধান জাতীয় সম্পদ, অতীতে তাই রাজারা কৃষকদের শ্রদ্ধা করতেন।” কনফুসীয় নীতিমালাতেও বলা আছে, ‘ঝং নং বিং শাং’ অর্থাৎ “কৃষিকে মর্যাদা দাও, বাণিজ্যকে নয়।” প্রচুর পরিমাণে নানা জাতের শস্য চীনে উৎপাদিত হতো। দক্ষিণ ও মধ্য চীনে ধান, আর উত্তর চীনে গম, ভুট্টা, সয়াবিন ও বাদাম প্রধান শস্য ছিল। চীনে নানা জাতের ভেষজ গাছ পালন করা হতো।
কৃষি চীনা অর্থনীতির ভিত্তি হলেও শিল্পে তারা মোটেই পিছিয়ে ছিল না। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছিল নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। পুরোনো ঐতিহাসিক নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, য়ৌ-ৎ সাও প্রথম স্থাপত্যবিদ্যার সূচনা করেন। আগুন ব্যবহারের শিক্ষা দেন সুয়েই জেন। চিত্রাঙ্কন প্রথা ও লিখিত অক্ষরের প্রচলন করেন ফু-শি। সময় পরিমাপের উপায়ও তিনিই উদ্ভাবন করেন। শেন নুং আবিষ্কার করেন লাঙল এবং কোদাল। ভেষজ চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। এছাড়াও খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের মধ্যেই চীনে আবিষ্কৃত হয়েছিল—(১) পোশাক ও টুপি, (২) যান ও নৌকা, (৩) হামান দিস্তা, (৪) তির-ধনুক, (৫) ধাতু মুদ্রা ও (৬) শবাধার। ‘শান তাই’ অথবা ত্রিবংশের সময় থেকে, (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১০০০) লু-য়ি বা ষড়শিল্প এবং লু-কু বা ষড়কর্ম পদ্ধতির চর্চা চীনে ছিল। ছ’রকম কর্মপদ্ধতি বা বিজ্ঞানের নাম হলো—(১) তু-কুং (স্থাপত্য), (২) চিন্-কুং (ধাতুবিদ্যা), (৩) শি-কুং (গৃহনির্মাণ শাস্ত্র), (৪) মু কুং (আসবাববিদ্যা), (৫) সউ-কুং (প্রাণীবিজ্ঞান) এবং (৬) ছাও-কুং (উদ্ভিদবিদ্যা)।
পুরনো চীনের শিল্প অর্থনীতি
লবণ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য বহু আগে থেকেই চীনে খনন চালানো হতো। ধাতু গলানোর জন্য ব্যবহৃত হতো জলচাকাবিশিষ্ট হাপর। খণ্ডিত তোরণ, ঝুলন্ত সেতু বানাবার কায়দা চীনারা রপ্ত করেছিল। এছাড়া তারা আবিষ্কার করেছিল ভূমিকম্প ও দিকনির্ণয়ের যন্ত্র, কাগজ, বারুদ, ছাপাখানা ও চীনামাটি। প্রায় সাত হাজার বছর আগে থেকেই চীনে রেশম শিল্পের খ্যাতি ছিল। রোমান ভাষায় চীনকে বলা হতো ‘সেরিকা’ কারণ লোহার ব্যবহার জানত বলে চীনাদের লৌহশিল্প পরবর্তীকালে দ্রুত উন্নতি করে। প্রথম খ্রিস্ট শতাব্দের লেখক প্লিনি জানিয়েছেন, তার সময়কার রোমে চীন থেকে আসা লোহাকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হত। অধ্যাপক নিডহামের মতে, পঞ্চম শতাব্দীর পর চীনারা যে-কোনো পরিমাণ ঢালাই লোহা তৈরি করতে পারত এবং ইস্পাত তৈরিতেও তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
শিল্পে ও বাণিজ্যে চীনের কর্মিক সংগঠন ছিল খুবই পুরোনো। কোনো বিশেষ শিল্পসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনকে বলা হত ‘হাং’। একই ব্যবসায়ে লিপ্ত লোকদের বলা হতো ‘তুং-হাং’। হাংগুলোর জেলা বা প্রদেশের প্রধান শহরে স্থানীয় কেন্দ্র থাকত, সেই সঙ্গে বছরে দুবার সাধারণ সভা আহুত হতো। প্রতিটি হাং কোনো বিশেষ দেবতার পুজো করত, যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় “সিদ্ধিদাতা গণেশ”-এর পুজো করা হয়।
তথ্যসূত্র
১. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ১০-১১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।