চীনের সামন্তবাদী সমাজ হচ্ছে একাদশ খ্রিস্টপূর্ব থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর সমাজ

চীনের সামন্তবাদী সমাজ (ইংরেজি: Chinese Feudal Society) হচ্ছে চীনের ইতিহাসে একাদশ খ্রিস্টপূর্বাব্দ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক আফিম যুদ্ধের (১৮৩৯) আগে পর্যন্ত চীনে বিরাজমান সামন্তবাদী সমাজের যুগ। অর্থাৎ চীনে সামন্তবাদ শ্যাং রাজবংশের শুরু থেকে (১১ খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দী – ১৭ শতাব্দী) অবধি অস্তিত্ব ছিল বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়।

কৃষিভিত্তিক চীনে খ্রিস্টপূর্ব একাদশ অব্দে সামন্তবাদের একটা গড়ন লক্ষ্য করা যায়। চৌ-বংশের আমলে সেই সামন্তবাদ পরিণত হয়ে উঠেছিল। ব্যাপক, কেন্দ্রীভূত ও দীর্ঘস্থায়ী এই সামন্তবাদী সমাজে পরিবারও এক বিশেষ নীতিকাঠামোর মধ্যে সাংগঠনিক ভিত্তিরূপ পেয়েছিল। ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক দ্বন্দ্ব—সবকিছুর কেন্দ্রেই ছিল এই পরিবার। জেন্ট্রি ও কৃষকদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও যেমন চীনা সামন্তবাদ ভেঙে যায়নি, তেমনি এই পরিবারও তার পুরোনো চেহারায় ছিল অটুট।[১]

প্রাচীন চীনের সামন্তবাদ

দীর্ঘকাল ধরে চীনের রাজনীতি-অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি। মধ্যযুগে কৃষি যেমন সংগঠিত উৎপাদনের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তেমনি একে কেন্দ্র করেই দানা বেঁধেছিল সামন্তবাদ। চীনের সামন্তবাদকে দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যায়। খ্রিস্টপূর্ব একাদশ অব্দে শুরু হয় আদি-ব্যবস্থার সামন্তবাদের (early feudalism) পর্যায়। তার প্রায় তিন-চারশো বছর পর দেখা যায় পরিণত সামন্তবাদ (mature feudalism)।

আদি সামন্তবাদ

ইয়াং-শাও, মতান্তরে লুং-শান সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা শাং বংশের শাসনকালে চীনের আদি সামন্তবাদ দেখা যায় বলে অনেকে মনে করেন। হোনান, পশ্চিম শান্টুং, দক্ষিণ হোপেই, মধ্য ও দক্ষিণ শাসি, পূর্ব শেসি এবং কিয়াংসু ও আনহুই-এর অংশবিশেষ নিয়ে আনুমানিক একাদশ-দশম খ্রিস্টপূর্বাব্দে গড়ে উঠেছিল শাং রাষ্ট্র। সেচভিত্তিক কৃষি আর অশ্ব-রথে চড়ে তীর-ধনুক দিয়ে লড়াই—এই ছিল শাং রাষ্ট্রের মূল শক্তি।

শাং রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা ও রাষ্ট্রের সব জমির মালিক ছিলেন রাজা, যিনি মৃত্যুর পর ‘তি’ বা পরমদেবতার মর্যাদা পেতেন। রাজার উত্তরাধিকারের নিয়ম ছিল মজার। একজন রাজা মারা যাওয়ার পর তার পরবর্তী ভাই রাজা হতেন। সব ভাইয়ের মৃত্যু হলে প্রথমে বড় ভাইয়ের ছেলেরা, বড় থেকে ছোট, তারপর তার পরে ভাইয়ের ছেলেরা পরপর রাজা হতেন। রাজার ‘চেন’ কর্মচারীরা অভিজাতদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হতেন। অভিজাত জমিদাররা রাজাকে ‘কর’ পাঠাতেন। অন্তত ৩০টি রাজ্য থেকে আসত নজরানা।

রাজার পরেই সামাজিক স্থান ছিল অভিজাতদের। তারাই হতেন জমির নিয়ন্ত্রক। তারা ঘোড়ার গাড়ি চড়তেন। সাধারণ মানুষের গাড়ি চড়ার অধিকার ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ কৃষিকাজে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তারা মূলত ছিলেন অভিজাতদের অধীনে ভূমিদাস। গ্রামের কারিগর ও শিল্পীরাও বংশপরম্পরায় তাদের অধীনে থাকতেন। শাং রাজা যখন অন্য কোনো রাজ্য জয় করতেন, তখন সেই রাজ্যের কৃষক-কারিগর-শিল্পীরাও এমনিভাবে দাস-এ পরিণত হতেন, আর সেই রাজ্যের অভিজাতরা শাং রাষ্ট্রের অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতেন। পরবর্তীকালে চৌ বংশ যখন শাং রাজ্য জয় করে নেয়, তখন শাং রাজ্যের বেলায় একই ঘটনা ঘটে।

সামন্তবাদের পরবর্তী পর্যায়

পশ্চিমী ধাঁচে না হলেও চৌ বংশের আমলে যে চীনে পরিণত সামন্তবাদের ছবি দেখা গিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। চৌ-রা পশ্চিম দিকের অঞ্চল থেকে পূর্ব দিকে শাং রাষ্ট্রের দিকে এগিয়েছিলেন। এক সময়ে শাংদের সঙ্গে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। তারপর দশম খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোনো এক সময় ব্রোঞ্জ ধাতুর উন্নততর অস্ত্রের অধিকারী চৌ-রা শাংদের যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে মধ্য জোনানা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চৌ-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। শাং-সংস্কৃতির সঙ্গে তারা জুড়ে দেন পশ্চিম থেকে নিয়ে আসা তুর্কি আর দক্ষিণ থেকে নিয়ে আসা তিব্বতি সংস্কৃতি।

ঘটা করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘সুং ফা’ বা মহামহিম চৌ-সম্রাট অভিজাতদের ভূম্যধিকার প্রদান করতেন, সেই সঙ্গে দেওয়া হতো একটি সনদ। তাতে লেখা থাকত, নতুন সামন্তপ্রভুর অর্থনৈতিক ও সামরিক দায়দায়িত্বের কথা। প্রথমে চৌ-বংশের আত্মীয়দের মধ্যেই এই ভূম্যধিকার বিলি করা হত, তারপর সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর মোড়লদের। বড় ভূস্বামীরা আবার স্বগোত্রের অন্যদের মধ্যে পত্তনি দিতেন। এইভাবে তৈরি হতো উপ-সামন্ত-সত্ত্ব। কয়েক শতকের মধ্যে ভূম্যধিকার হয়ে যায় পারিবারিক এবং হাং বংশের রাজত্বের সময় (আনুমানিক ২০৬-২২০ খ্রিস্টাব্দ) অভিজাত চীনারা কৌমের বদলে পরিবারের নামেই পরিচিত হতে থাকে। এই অভিজাতদের মধ্য থেকেই চীনের সামন্ত প্রশাসক শ্রেণি বা ম্যান্ডারিন তৈরি হয়েছিল। প্রধানত ছ’রকমের ম্যান্ডারিন তখন দেখা যেত। রাজকীয় দপ্তরের জন্য ‘Mandarin of Heaven’, জনকল্যাণের জন্য ‘Mandarin of Earth’, ধর্মানুষ্ঠানের জন্য ‘Mandarin of Spring’ প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধের জন্য ‘Mandarin of Summer’ বিচারের জন্য ‘Mandarin of Autumn’ এবং পূর্ত দপ্তরের জন্য ‘Mandarin of Winter’। 

সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য

প্রথম ও দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চীনে সামন্তবাদ সংহত হয়ে উঠেছিল। এই সামন্তবাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। চীনা সামন্তবাদ ছিল অত্যন্ত ব্যাপক ও কেন্দ্রীভূত। সাধারণ ব্যবহার্য হস্তশিল্পভিত্তিক সব বস্তু কৃষকরা ও তাদের সহযোগী কারিগররা গ্রামেই তৈরি করে নিত বটে, কিন্তু খনিজ শিল্প ও উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো ভূস্বামী রাষ্ট্রে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। নিয়ন্ত্রিত শিল্পের কারিগররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল রাষ্ট্রীয় দাস। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সংগঠিত রাজকীয় আমলাতন্ত্র সম্রাটের নেতৃত্বে ভূস্বামীদের প্রশাসনিক প্রয়োজন মেটাত। কিন্তু এই আমলাতন্ত্র স্বতন্ত্র শাসকগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে ওঠেনি। সুতরাং চীনা সামন্তবাদ ছিল কেন্দ্রীভূত এক অতি উন্নত সামন্তব্যবস্থা।

চীনের সামন্তবাদী সমাজ ছিল দীর্ঘস্থায়ী। সমাজে পুঁজির বিকাশের শর্ত উপস্থিত ছিল না তা নয়, কিন্তু তবুও সামন্ত ব্যবস্থা টিকে গিয়েছিল। মিং রাজবংশের আমলে (১৩৬৮-১৬৪৪) সামন্ত খাজনা ও দৈহিক শ্রমকে একত্রিত করে রৌপ্য মুদ্রায় দেয় অর্থ খাজনায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। চিং রাজবংশের আমলে কুয়াংসি প্রদেশের খনিশিল্পে, কুয়াংতোং প্রদেশের বস্ত্রশিল্পে বা চিয়াংসি প্রদেশের চীনামাটির শিল্পে শ্রমবিভাগের বিকাশ ঘটেছিল। শানসি প্রদেশের খাজাঞ্চিখানায় প্রাচীন ব্যাঙ্কিং ও ঋণব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও চীনা সামন্তব্যবস্থার দেওয়াল ভাঙেনি। এর কারণ সংগঠিত চীনা সামন্তবাদে ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণি ভূস্বামীদের অধীনস্থ হয়ে যেত ও এই তিনের নিবিড় সমন্বয় সামন্তবাদকে শক্তিশালী করে তুলত। যেহেতু ব্যবসায়ীদের ও মহাজনদের রাজনৈতিক আভিজাত্য স্বীকার করা হত না, তাই তারা পুঁজির মালিক হওয়ার পর ভূস্বামী শ্রেণি ও রাজকীয় আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। এতে চীনা সামন্তব্যবস্থারই সংহতি বৃদ্ধি পেত।

উপসংহার

চীনের সামন্তবাদী সমাজ বা মধ্যযুগের অবসান ঠিক কখন হয়, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। পুরাতনপন্থী চৈনিক ঐতিহাসিকরা, যেমন শিয়াও-ই-শান, চিং-তাই-তুং-শি, মনে করেন, মিং যুগের অবসানের পর চিং যুগের শুরুতে মধ্যযুগের শেষ হয়। কেননা পাশ্চাত্যের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রপাত এই সময়েই। নব্য ইতিহাসবিদেরা যেমন ফেয়ারব্যাঙ্ক, ভিষাক, ইম্যানুয়েল সু প্রভৃতি ঐতিহাসিক আফিম যুদ্ধের (১৮৩৯) আগে পর্যন্ত চীনে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়নি বলে মনে করেন। কারণ এই যুদ্ধের পরই (১৮৩৯-৪২) চীনের বিচ্ছিন্নতার প্রকৃত অবসান ঘটে। জঁ শ্যেনো, ইস্রায়েল এপস্টেইন, জিয়ান বোজান, মারিয়ানে বাস্তিদ প্রভৃতি ঐতিহাসিকরাও আফিম যুদ্ধকেই মধ্যযুগ-আধুনিক যুগের বিভাজক-রেখা হিসেবে গণ্য করেছেন। কেননা, এর পরেই সামন্তবাদী চীন আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক চীনে পরিণত হয়।

তথ্যসূত্র

১. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ৬-৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!