আপাত-সামন্তবাদী বা আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক চীন (ইংরেজি: Semi-feudal semi-colonial China) হচ্ছে আফিম যুদ্ধ থেকে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৮৪০ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের চীনের ইতিহাস। ঐতিহাসিকগণ আফিম যুদ্ধকেই চীনের সামন্তবাদী যুগ ও আধুনিক যুগের বিভাজক-রেখা হিসেবে গণ্য করেছেন। কেননা, এর পরেই সামন্তবাদী চীন আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক চীনে পরিণত হয়।
সংস্কার আন্দোলন থেকে অসমাপ্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব
চীনের আধুনিক ইতিহাসে আফিম যুদ্ধ কথাটিও ঘটনা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যের নানা শক্তি ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য তাদের নৌবহর ইত্যাদি নিয়ে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। চীনের আফিম এর চাষ খুব লাভজনক বলে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহ বিবেচনা করে। চীনা সরকার চীনের সঙ্গে অবাধে চীন থেকে আফিম সংগ্রহে বাধাদানের চেষ্টা করে। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে পাশ্চাত্য শক্তির সংঘর্ষ এক পর্যায়ে যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে। এই সংঘর্ষই আফিম যুদ্ধ বলে অভিহিত হয়। আফিং কেনা বেচার এই যুদ্ধ ১৮৪২ পর্যন্ত চলে।[১]
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে চীনের দুর্বল মাঞ্চু রাজতন্ত্র রাষ্ট্রকে সক্রিয় নেতৃত্বদানে অপারগ হয়ে পড়ে। জরাগ্রস্থ এই রাজতন্ত্র পশ্চিমী আগ্রাসনকে রোধ করতে পারেনি। ইঙ্গো-চীনা আফিম যুদ্ধের পর ১৮৪২ সালে সম্পাদিত নানকিং-এর সন্ধি মাঞ্চু রাজতন্ত্রের জয়প্রিয়তা অনেকটাই হ্রাস করেছিল। এই সময় স্থানে স্থানে বিদ্রোহের মাধ্যমে গণ-অসন্তোষ প্রকাশ পেতে থাকে। এই বিদ্রোহ তরঙ্গের চরম পরিণতি ছিল তাইপিং বিদ্রোহ। চীনা সরকারের এই দুর্দিনে পশ্চিমী রাষ্ট্রশক্তি নিজ সুবিধার্থে অনেক অন্যায় সুবিধা আদায় করে নেয়। চীনা জনগণ নিজ বাসভূমিতে কোনো প্রকার সুবিধা, সুবিচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। চীনা সমাজ-ব্যবস্থার কৃষক শ্রেণি ছিল সর্বাপেক্ষা অবহেলিত শ্রেণি। রাজস্ব ব্যবস্থার অরাজকতা, কৃষিযোগ্য জমির অপ্রতুলতার জন্য কৃষক শ্রেণি প্রায় অর্ধদাসে পরিণত হয়েছিল। সরকারি পক্ষ থেকে কৃষক ও কৃষির উন্নতির জন্য কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। এই সময় যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হলো তাতেও জনসমর্থনের বিষয়টি অবহেলিত ছিল। তাই জনসমর্থনে অভাবে সংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
এরপর চীন বক্সার বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা লাভ করে। এই বিদ্রোহ গুপ্ত সমিতি দ্বারা পরিচালিত ছিল এবং এর লক্ষ্য ছিল বিদেশিরা। নানা কারণে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায় এবং বিদেশি নিষ্পেষণ আরও বৃদ্ধি পায়। এই সময় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ও বিংশ শতকের সূচনায় চীনা জনসংখ্যা বিস্ফোরক হারে বৃদ্ধি পায় (১৮৮৫-১৯১০ পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩০ মিলিয়ন), খাদ্যাভাব দেখা দেয়, জমির উপর চাপ পড়তে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ক্ষতিপূরণদানের সমস্যা। চীন-জাপান যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, বস্তার বিদ্রোহের ক্ষতিপূরণ প্রভৃতির অর্থ দিতে গিয়ে মাঞ্চু রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। এই অর্থাভাব মেটাতে গিয়ে সরকার বাড়তি করের বোঝা জনগণের উপর চাপিয়ে দেন ফলে জন-অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এই সময় বিপ্লবী সংবাদপত্রগুলি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিন-পাও (Min-Pao) সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করে। সান-ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বে টুং-মেং-হুই বা সম্মিলিত দল ছিল বিপ্লবের কর্ণধার। তিনিই জাতীয়তাবাদী সংগঠিত করে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯১১ সালে চীনে স্থাপিত হয় প্রজাতন্ত্র।[২]
বিদ্রোহকে চীন দেশের একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অধিকার দৈব নির্দেশের তত্ত্বের মধ্যে নিহিত ছিল এবং তা কনফুসিয় দর্শন দ্বারা সমর্থিত ছিল। চীনে পশ্চিমী শক্তির অনুপ্রবেশের ফলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, মাঞ্চু সরকারের দুর্নীতির এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে একের পর এক চীন লাভ করেছিল বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা। তাইপিং বিপ্লব, বক্সার বিদ্রোহ এবং সর্বশেষে ১৯১১ সালের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব যার ফলে চীন লাভ করে প্রজাতন্ত্র। তবে ১৯১১ সালের বিপ্লব ছিল অসম্পূর্ণ, কারণ চীনের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এই বিপ্লবের ফলে দূরীভূত হয়নি। যদিও মাঞ্চু বংশের পতন হয়ে প্রজাতন্ত্রের পতন হলো কিন্তু তা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে এনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কারণ চীনে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ দূরীভূত হয়নি, নিশ্চিহ্ন হয়নি সামন্তবাদ, তাই প্রকৃত প্রজাতন্ত্র ১৯১১ সালের বিপ্লবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই কারণে বিপ্লবটি ছিল অসম্পূর্ণ বিপ্লব।
সান-ইয়াৎ-সেন রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার সুবিধার্থে উয়ান-শি-কাই নামক মাঞ্চু রাজবংশের এক প্রভাবশালী সেনাপতির পক্ষে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করেন। কিন্তু চীনের নতুন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি উয়ান-শি-কাই গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিপ্লবীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সান ইয়াৎ-সেনের গণতন্ত্রের আদর্শ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীনে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য উয়ান-শি-কাই-এর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় একটি বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভূত হয়। দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য সান-ইয়াৎ-সেন কুয়োমিনতাং বা চীনা জাতীয়তাবাদী দল নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দল দক্ষিণ চীনে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করে। এই সময় সান-ইয়াৎ-সেন পশ্চিমী রাষ্ট্রের শোষণমূলক চুক্তিগুলি নাকচ করার চেষ্টা করেন। ১৯২৫ সালে তাঁর মৃত্য হলে তাঁর কার্য অসমাপ্ত রয়ে যায়, আধা-সামন্তবাদী চীন একই অবস্থায় থেকে যায়।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম
১৯১৯ -এর ৪ঠা মে আন্দোলনের পরবর্তীকালে চীনের শ্রমিক আন্দোলন বিস্তারলাভ করতে থাকে। কমিউনিস্ট মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ চীনা বুদ্ধিজীবীরা সাংহাই, হুনান এবং অন্যান্য এলাকার শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, বিভিন্ন এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন, ক্লাব, আংশিক সময়ের বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। পিকিং, সাংহাই, কোয়াংচৌ এলাকায় সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। যার মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে কমিউনিস্ট চিন্তাভাবনা প্রচার করা হয়। এইভাবে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ১৯২০ সালের গ্রীষ্মকালে সাংহাই শহরে প্রথম মার্কসবাদী গোষ্ঠীর জন্ম হয়। একই বছরের আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় চীনের সমাজতান্ত্রিক যুব লিগ। একই সময়ে পিকিং, হ্যাংকোউ, চাংশা এবং অন্যান্য বহু এলাকায় মার্কসবাদী গোষ্ঠী ও সমাজতান্ত্রিক যুব লীগ গড়ে ওঠে। এছাড়া দেশের বাইরে প্যারিস ও টোকিওতে একই জিনিস দেখতে পাওয়া যায়। অবশেষে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে সাংহাই শহরে চূড়ান্ত গোপনীয়তার মধ্যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়।
উপসংহার
আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক চীন বদলে যেতে থাকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ধারাবাহিক কার্যক্রমে। ১৯৪৯ সালের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং শ্রমিক ও কৃষকের যৌথ একনায়কত্ব চীনকে পৌঁছে দেয় বিশ্ব ইতিহাসের নির্ধারক শক্তিতে। ১৯৫৬ সালে সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে চীনের পুঁজিবাদী যুগের সাময়িক অবসান ঘটায়।
আলোকচিত্রের ইতিহাস: লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি Huangdan তুলেছেন ১ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে সেনঝেন যাদুঘর থেকে। যাদুঘরে ভাস্কর্য ও অন্যান্য মাধ্যমের সহায়তায় প্রথম আফিম যুদ্ধকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. সরদার ফজলুল করিম, দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা, ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২, পৃষ্ঠা ৩০০।
২. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ৮০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।