কনফুসিয়াসবাদ বা কনফুসীয়বাদ প্রাচীন চীনে উদ্ভূত চিন্তা ও আচরণের ব্যবস্থা

কনফুসিয়াসবাদ বা কনফুসীয়বাদ (ইংরেজি: Confucianism), রুইবাদ নামেও পরিচিত, প্রাচীন চীনে উদ্ভূত চিন্তা ও আচরণের একটি ব্যবস্থা। বিভিন্ন প্রকারে কনফুসিয়াসবাদকে ঐতিহ্য, একটি দর্শন, একটি ধর্ম, একটি মানবতাবাদী বা যুক্তিবাদী ধর্ম, শাসনের একটি উপায়, বা সহজভাবে জীবনযাত্রা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের (৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শিক্ষা থেকে কনফুসিয়াসবাদের বিকাশ ঘটে যাকে পরবর্তীতে ‘শতদর্শন শিক্ষায়তন’ (ইংরেজি: Hundred Schools of Thought) বলা হয়।

কনফুসিয়াসের উপদেশাবলী মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত ছিল। প্রাচীন সমাজে তিনি কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যত পরিচিত নন তার চেয়ে চীন সমাজের সংরক্ষণকারী হিসাবেই তাঁর ঐতিহাসিক পরিচয়। মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থায় এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক কিরূপ জীবন যাপন করবে এর প্রতিটি বিষয়ে কনফুসিয়াস তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর সমস্ত উপদেশের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করা।

কনফুসিয়াসবাদ প্রসঙ্গে আলোচনা

কনফুসিয়াস প্রচলিত অর্থে ধর্মপ্রচারক ছিলেন না, ছিলেন নীতিশিক্ষক। বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল লিখেছেন, কনফুসিয়াসকে প্রাচীন গ্রীসেও লাইকারগাস বা সোলোনের সম-আসনে রাখাই ভালো (Confucius himself belongs rather to the type of Lycurgus and Solon than to that of the great founders of religious-Bertrand Russell: The Problem of China). কনফুসিয়াস নিজে কোনো মৌলিক তত্ত্বের দাবি করেননি। তিনি তাঁর নীতিধর্মে (লি) প্রাচীন জ্ঞানের প্রসার ঘটানোর কথা বলেছিলেন। তিনি পাঁচটি নৈতিক বিষয়ের কথা বলেন—দান, শুচিতা, জ্ঞান, ন্যায়বোধ ও বিশ্বাস।

এছাড়াও তিনি ছ’টি গুণের অনুশীলনের উপদেশ দিয়েছিলেন। সেগুলো হলো, সু (পরার্থপরতা), জেন (মানবিকতা), ই (সত্যনিষ্ঠা), লি (শালীনতা), চি (প্রজ্ঞা) ও সিন (আন্তরিকতা)। রাজা-প্রজা, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ এবং বন্ধু-বান্ধবী এই পঞ্চ সম্বন্ধের ব্যাখ্যা কনফুসীয় নীতিমালার অন্যতম অংশ। কনফুসিয়াস শাসকের কল্যাণকর শাসন ও ন্যায়সংগত আচরণের ওপর জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন, রাজা তার কর্তব্যে ব্যর্থ হলে প্রজার বিদ্রোহ বৈধ। তাঁর মতে, প্রজারাই রাষ্ট্রশক্তির ভিত্তি।

কনফুসিয়াসের শিক্ষায়তনকে বলা হতো ‘শতদর্শন শিক্ষায়তন’। তাঁর শিক্ষার প্রধান তিনটি বিষয় ছিল ইতিহাস, সাহিত্য ও নীতিশাস্ত্র। প্রাচীন ঐতিহ্যকে মর্যাদা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কনফুসিয়াস ধ্রুপদী বিদ্যা উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন। ইতিহাস মন্থন করে তিনি গ্রন্থপঞ্চক সংকলন করেছিলেন। এগুলো হলো:

১. লি চি বা অনুষ্ঠানপঞ্জি। এতে আছে ধর্মব্যাখ্যা ও সদাচারের নিয়মাবলি;
২. ই কিং বা পরিবর্তন-তত্ত্ব। প্রধানত জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যামিতিক-বিদ্যা এতে আছে;
৩. সি কিং বা কাব্যগ্রন্থ। এটা মানুষের জীবন ও নীতি বিষয়ে অনেক প্রাচীন কবিতার সংকলন ;
৪. চুন-কিউ বা বসন্ত ও শরতের বিবরণ। এটা কনফুসিয়াসের মাতৃভূমি লু-র ইতিহাস;
৫. সু-কিং বা ইতিহাসগ্রন্থ। এটা আদি চীনের ইতিবৃত্ত।

এই গ্রন্থপঞ্চক ছাড়াও চারটি ‘সু’ বা গ্রন্থ, মোট ন’টি গ্রন্থের সমষ্টি কনফুসীয় নীতিশাস্ত্র নামে পরিচিত। ‘প্রাজ্ঞবচন’ বা Analect তার একটি, কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা তাঁর উপদেশাবলি এই গ্রন্থে সংকলিত করেন। অন্য তিনটি গ্রন্থ হলো: (১) টা-সুয়ে বা মহাবিদ্যা, (২) চু ইয়াং বা মধ্যপন্থা এবং (৩) মেনসিয়াসের গ্রন্থ। সক্রেটিসের ভাষ্যকার যেমন প্লেটো, মেনসিয়াসও তেমনি ছিলেন কনফুসিয়াসের ভাষ্যকার।[১]

কনফুসিয়াসবাদ ও রক্ষণশীলতা

পৃথিবীর উপরে যদি কাউকে মান্য করতে হয় তা হলে মানুষ মান্য করবে ঈশ্বরকে, ঈশ্বরের বিধানকে। যে মানুষ মহৎ সে ঈশ্বরের বিধানেই মহৎ। যে-মানুষ অধম সে ঈশ্বরের বিধানেই অধম। এর কোনো পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে না। প্রশ্ন হচ্ছে সেই বিধানকে সুসঙ্গতভাবে মেনে চলা। যে রাজা, সে ঈশ্বরের বিধানেই রাজা। ছোটর কর্তব্য হচ্ছে বড়কে মানা। রাজা-প্রজা, পতী-পত্নী, পিতা-পুত্র, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ, এই প্রকারের সম্বন্ধের ভিত্তিতেই সমাজ গঠিত। বিধির বিধানে যে স্থানে যে অধিষ্ঠিত সেই স্থান অনুযায়ী দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করা তার কর্তব্য। রাজার আদর্শ হবে উত্তম রাজা হবার এবং প্রজার আদর্শ হবে উত্তম প্রজারূপে তার দায়িত্ব পালন করা।

কনফুসিয়াস-এর অনুসারীগণ বিভিন্নভাবে কনফুসিয়াসবাদ বা কনফুসিয়াসের অভিমতকে ব্যাখ্যা করেন। তার ফলে কনফুসিয়াসবাদেও বিভিন্ন উপধারার উদ্ভব হয়। কনফুসিয়াসের অন্যতম শিষ্য মেঙজু মনে করতেন যে, সমাজে যে অসাম্য বিদ্যমান তা বিধাতারই বিধান। বিশ্ব প্রকৃতির ব্যাখ্যায় কনফুসিয়াসের অপর এক অনুসারী সুনজু কিছুটা বস্তুবাদী মত প্রচারের প্রয়াস পান। তাঁর মতে ঈশ্বর প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির ঊর্ধ্বে কোনো সত্তা নয়।

খ্রিষ্টাব্দের একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে চুশী এবং অন্য অনুসারীগণ নব কনফুসিয়াসবাদের প্রবর্তন করেন। তাঁদের মতে বিশ্বের মূলে রয়েছে ‘লী’ এবং ‘চী’র দ্বন্দ্ব। ‘লী’ হচ্ছে ভাব, আর ‘চী’ হচ্ছে বস্তু। ‘লী’র কারণেই মানুষের মধ্যে মহত্ত্বের সৃষ্টি আর ‘চী’র কারণে মানুষ লোভ, মোহ ইন্দ্রিয় সুখ ইত্যাদির কাছে আত্মসমর্পণ করে। সুর্দীঘকাল স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় চীনে তিনটি ভাবাদর্শের উদ্ভব দেখা যায়। এই তিনটির একটি হচ্ছে কনফুসিয়াসবাদ এবং অপর দুটি হচ্ছে তাও এবং বৌদ্ধ ধর্ম।[২]

তথ্যসূত্র

১. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ১১-১২।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১১৮-১১৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!