কনফুসিয়াস (ইংরেজি: Confucius; ৫৫১–৪৭৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) ছিলেন শরত বসন্তকালের একজন চীনা দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ যাকে ঐতিহ্যগতভাবে চীনা ঋষিদের পরমোতকর্ষ হিসাবে বিবেচনা করা হতো। মানুষকে অসত্য থেকে সত্যে, অজ্ঞানতা থেকে প্রজ্ঞার পথে উত্তরণের জন্য জগতে যুগে যুগে যে সকল মহৎ চিন্তাবিদ দার্শনিক মানবতাবাদী মনীষী আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে চীন দেশের কনফুসিয়াস অন্যতম।
কনফুসিয়াসের আবির্ভাবের আড়াই হাজার বছর পরেও তার চরিত্রের গুণাবলী ও মহৎ অবদানের কথা স্মরণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্মরণ করে। তাঁর দর্শন ও রচনাবলী চীনসহ পূর্ব এশিয়ার জীবনদর্শনে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। কনফুসিয়াস মূলত নীতিবাদী দার্শনিক ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে নীতিজ্ঞান।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে, খ্রিস্টের জন্মের ৫৫১ বছর আগে চীনের লু রাজ্যের শান্টং প্রদেশের অন্তর্গত ফায়াক নগরে কনফুসিয়াস জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম খুঙ। লোকগুরু রূপে খ্যাতি লাভ করার পর তার নাম হয় খুঙ-ফু-সে অর্থাৎ শিক্ষাগুরু খুঙ। এই কথার ল্যাটিন রূপই কনফুসিয়াস। এই নামেই তিনি পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছেন।
মহাত্মা কনফুসিয়াসের জন্মের কিছুকাল আগেই ৬০৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে চীন দেশে তাও ধর্মের বাণী প্রচার করে গেছেন লা-ও-ৎসে। দক্ষিণ এশিয়ায় কয়েক বছর আগেই আবির্ভাব ঘটেছে গৌতম বুদ্ধের, ৫৬৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে।
চীনদেশের লু রাজ্যে বাস করতেন শ্যালোং হেউ বা লু শিয়াং নামে একজন উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী। সুপ্রাচীন সাং রাজবংশের অন্যতম বংশধর ছিলেন তিনি। বীরত্ব সাহস ও কৃতিত্বের জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল। পুত্রসন্তান কামনায় একাধিক পত্নীর পাণি গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তথাপি, কোনো পত্নীর গর্ভে পুত্রের জন্ম না হওয়ায় তাঁর মনে শান্তি ছিল না। জানা যায়, নয়টি কন্যার পিতা হয়েছিলেন লু শিয়াং।
একবার এক গ্রাম্য পথে চলার সময় তিনি তৃষ্ণার্ত হয়ে এক চাষীর কুটিরে গিয়ে জল চাইলেন। চাষীর কিশোরী মেয়ে চেং সাই এসে তাকে জল দিল। সুলক্ষণা মেয়েটিকে দেখে লু শিয়াং-এর মনে হলো, তাঁর গর্ভে নিশ্চয়ই তার পুত্র সন্তান জন্মাবে। ঢাষীর কাছে তিনি মেয়েটিকে বিবাহ করার অনুমতি চাইলেন।
সেই গ্রামেই আত্মীয় পরিজনদের অজ্ঞাতে লু শিয়াং চেং সাইকে বিয়ে করলেন। এই বিয়ের কথা অন্য স্ত্রীরা যাতে জানতে না পারেন সেই জন্য তিনি চেং সাইকে পিতৃগৃহেই রেখে এলেন। এই ঘটনার কয়েক মাস পরেই নিজ গৃহে অসুস্থ হয়ে পরলোক গমন করেন লু শিয়াং।
যথাসময়ে নবপরিণীতা চেং সাই একটি সর্বসুলক্ষণ যুক্ত পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। এই নবজাতক শিশু সন্তানই পরবর্তীকালে কনফুসিয়াস নামে জগতের মানুষের শ্রদ্ধাভক্তি লাভ করেন। লু শিয়াং নিজের পরিচয়টুকুর বাইরে হতভাগ্য চেং সাইকে অর্থ সম্পত্তি কিছুই দিয়ে যেতে পারেন নি। চেং সাই কিন্তু তার জন্য মাতৃত্বের দায়িত্ব অস্বীকার করেন নি।
শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করে রাজধানী শহর চুর কাছে এক গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে লাগলেন। চরম অভাব অনটনের মধ্যে মায়ের স্নেহে যত্নে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন কনফুসিয়াস। স্বামীর বংশ মর্যাদা ও বীরত্বের জন্য গর্ববোধ করতেন চেং সাই। শিশু বয়স থেকেই মায়ের শিক্ষায় পিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছিলেন কনফুসিয়াস।
কনফুসিয়াসের শিক্ষাজীবন
বয়স একটু বাড়লে ছেলেকে স্কুলে পাঠালেন চেং। অসাধারণ মেধা ছিল কনফুসিয়াসের। জ্ঞান অর্জনেও ছিল প্রবল আগ্রহ। তাছাড়া ধর্মবিশ্বাস ছিল তার সহজাত। স্কুলে ছাত্রশিক্ষক সকলেরই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন কনফুসিয়াস। চেং সি নামে এক গুণী শিক্ষকের উপযুক্ত শিক্ষায় পনের বছর বয়সের মধ্যেই অসাধারণ বিদ্বান হয়ে ওঠেন তিনি।
সেইকালে প্রাচীন চিনে তাও ধর্মের প্রভাব থাকলেও সমাজ ছিল নানা কুসংস্কারে পূর্ণ। ধর্মের নামে লোকে নানা অসার ও যুক্তিহীন আচার অনুষ্ঠান পালন করত। প্রকৃতির নানা বিপর্যয়কে তারা ঈশ্বরের ক্রোধ মনে করে তা প্রশমনের জন্য বিচিত্র সব মন্ত্রতন্ত্র ক্রিয়াকর্ম করত।
দেশজুড়ে ছিল অভাব অনটন। ন্যায়নীতি, ধর্মবোধ, শান্তি শৃঙ্খলা কোথাও ছিল না। দেশের সম্ভ্রান্ত ও ধনীক শ্রেণির নিপীড়ন অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিল দরিদ্র সাধারণ মানুষ। এই বিশৃঙ্খল সামাজিক পরিমন্ডলের গভীর প্রভাব পড়েছিল কিশোর কনফুসিয়াসের মনে। তিনি ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের কলাণচিন্তায় সেই বয়সেই খুব অধীর হয়ে উঠেছিলেন।
তার মায়ের ইচ্ছা ছিল, পুত্র উপযুক্ত লেখাপড়া শিখে রাজদরবারে কোনো কাজ গ্রহণ করেন এবং নিজের কর্মকৃতিত্বের মধ্য দিয়ে পিতৃ পরিচয় তুলে ধরেন। কিন্তু তার সেই ইচ্ছায় বাধ সাধলেন অন্তর্যামী। কনফুসিয়াসের যখন ১৫ বছর বয়স সেই সময় হঠাৎ তার মা মারা যান। মা-ই ছিলেন তার জীবনের সর্বস্ব। তাঁকে হারিয়ে নিদারুণ শোক পেলেন তিনি।
কিন্তু অন্তর্নিহিত জ্ঞানের বলে কনফুসিয়াস এই বিয়োগ বেদনা অল্প সময়েই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেন। জীবনের সকল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই তিনি তার অধ্যয়ন ও বিদ্যা শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন। মাতৃবিয়োগের পর সংসারে বন্ধন বলতে আর কিছু রইল না। তার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা জ্ঞান অর্জন। একান্ত মনে সেই কাজেই নিজেকে এবার থেকে নিবিষ্ট করলেন।
কনফুসিয়াসের কর্মজীবন
ক্রমে ক্রমে তার অসাধারণ জ্ঞান ও পান্ডিত্যের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমে সেই খ্যাতি লু রাজ্যের রাজার কানেও পৌঁছল। সেই সঙ্গে তার দারিদ্র্যের কথাও জানতে পেরে কনফুসিয়াসকে শস্য ভান্ডারের হিসাব রক্ষকের পদে নিয়োগ করলেন তিনি। সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষকেই এই গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব দেওয়া হতো। কর্ম প্রাপ্তির কিছুকাল পরেই ১৯ বছর বয়সে বিবাহ করেন কনফুসিয়াস।
তার স্ত্রীর নাম পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। তাদের এক কন্যা ও দুই পুত্র জন্মেছিল বলে জানা যায়। তবে যেহেতু পার্থিব সুখের চেয়ে জ্ঞানের প্রতিই কনফুসিয়াসের আকর্ষণ ছিল বেশি, তার সংসার জীবন যে বিশেষ সুখের হয়নি তা অনুমান করা যায়। অনেকে বলেন, স্ত্রীর সঙ্গে পরে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়েছিল। তবে অকালে স্ত্রী বিয়োগের কথাও বলেছেন অনেক ঐতিহাসিক।
কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার বলে অল্পদিনেই পদোন্নতি ঘটল কনফুসিয়াসের। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান করতেন। নানা স্থানে ছুটে যেতেন। একসময়ে গুপ্ত বিদ্যা বিষয়ক দুটি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পান তিনি।
দুটির মধ্যে একটি পুঁথির নাম ইচিং। কথাটির অর্থ পরিবর্তনের ধারা। এই পুঁথিগুলিতে মোট চৌষট্টিটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে জগতের পরিবর্তনের ধারা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। অতীত ও বর্তমান সহ ভবিষ্যৎ বিষয়েও নানা কথা ছিল তাতে। স্বভাবতই গুপ্তবিদ্যা বিষয়ের এই পুঁথি কনফুসিয়াসের মনোযোগ আকৃষ্ট করল।
দ্বিতীয় পুঁথির নাম শিচিং। এটি প্রকৃতি বিষয়ক কবিতার সংকলন। ছন্দবন্ধ গীতিময় কবিতার মাধ্যমে এতে চীন দেশের রাজবংশের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এই সকল কবিতা পাঠ করে কনফুসিয়াসের মনে হলো, সুর বসিয়ে এগুলিকে গান হিসেবে তিনি গাইবেন। কিন্তু সংগীত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা তার ছিল না। তাই একজন প্রবীণ সংগীত শিক্ষকের কাছে কিছুকাল সংগীত শিক্ষা করে পুঁথির কবিতাগুলিকে গান হিসাবে গাইতে আরম্ভ করলেন।
গানগুলি রচয়িতার নাম কেউ জানত না। কিন্তু গভীর আন্তর অনুভূতির বলে রচয়িতার সত্যকার পরিচয় কনফুসিয়াসের অন্তরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি তার সংগীত গুরুকে জানালেন, এ সকল গান রচনা করেছেন, রাজা ওয়েন। তিনি আরো জানালেন, রাজা ওয়েন ছিলেন দীর্ঘদেহী পুরুষ, ময়লা গায়ের রং। মন ছিল উদার। সংগীত শিক্ষক বংশানুক্রমিক শিক্ষার ফলে এই গোপন তথ্য জানতেন। তাই কনফুসিয়াসের কথা শুনে তিনি বিস্মিত হলেন। কনফুসিয়াসের অলৌকিক শক্তির পরিচয় এই সংগীত শিক্ষকই প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
এই সংগীত শিক্ষক ছিলেন যথার্থ পন্ডিত ও গুণী ব্যক্তি। কিন্তু অন্ধ। গুরুর প্রতি কনফুসিয়াসের শ্রদ্ধাভক্তি ছিল অটুট। পরবর্তীকালে তিনি যখন দেশ বিখ্যাত জ্ঞানী বলে সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন, তখনও কোনো অন্ধ গায়ক বা সংগীত শিক্ষককে দেখলেই তাকে সম্মান জানাতেন। এমনই ছিল তার চারিত্রিক উদারতা ও মহত্ত্ব।
রাজ দরবারে শস্যভান্ডারের হিসাব রক্ষকের কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল কনফুসিয়াসের। পরে তাকে দেওয়া হলো গবাদিপশুর তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণের কঠিন দায়িত্ব। সেই সময়ে তিনি একুশ বছরের তরুণ। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বের কাজ পেয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেননি কনফুসিয়াস। কেননা, একটি আদর্শ দেশ গঠনের রূপকল্প এতদিনে তিনি নিজের মনে ছকে ফেলেছিলেন।
সেই লক্ষ্য রূপায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল দেশের শাসন ব্যবস্থা ও ধর্মীয় আচার-আচরণের নিয়ন্ত্রণ। সেই ক্ষমতার অধিকারী না হওয়া পর্যন্ত তিনি মনে শান্তি পাচ্ছিলেন না। এই সময়ে সুযোগ পেলেই তিনি শহরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের অবস্থা সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতেন। পর্যালোচনা করতেন প্রচলিত রাষ্ট্রনৈতিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অভাব অনটন, ধর্মীয় পুরুষদের অনাচার, সম্ভ্রান্ত সমাজের স্বেচ্ছাচার দেখে তিনি অসহনীয় মানসিক পীড়া বোধ করতেন।
সেইকালে চিনের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। দেশে তখন চু বা চাউ বংশীয় সম্রাটদের রাজত্ব। প্রজা শাসন ভুলে সম্রাট বিলাস-ব্যসনেই মত্ত। সেই সুযোগে সামন্ত রাজারা স্বাধীন হয়ে ওঠার চেষ্টায় মেতে উঠেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র দেশ। স্বৈরাচারী সামন্ত রাজারা পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত। ফলে শাসন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, জনজীবন বিধ্বস্ত। কোথাও শান্তি শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই।
এই অবস্থার মধ্যে থেকে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও গভীর চিন্তার বলে কনফুসিয়াস উপলব্ধি করতে পারলেন, কেবলমাত্র শিক্ষার অভাবেই দেশের এই সর্ব ব্যাপী বিশৃঙ্খলা। শৃঙ্খলাই ঈশ্বরের বিধান। তাই বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে ধ্বংস। মানুষের বিবেকবোধ, নীতিবোধ জাগরিত হলে দূর হবে এই বিষাক্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা। আর প্রকৃত শিক্ষার মধ্য দিয়েই জাগতে পারে বিবেকবোধ। ধর্মীয় চেতনা, নিজের উপলব্ধি, ভাবনা চিন্তা নিয়ে তিনি রাজপুরুষ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তার গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এই ভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল দুর দুরান্তে। ছাত্ররা দলে দলে তার কাছে শিক্ষা লাভের জন্য আসতে লাগল।
চাকরি ত্যাগ করে কনফুসিয়াস জ্ঞানান্বেষী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দানের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। তাদের নীতিবোধ ও মুক্তবুদ্ধি উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে সুব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাবান করে তোলার কাজকেই তিনি জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করলেন। তাঁর ছাত্র নির্বাচনের পদ্ধতি ছিল বিচিত্র। সমাজের সকল স্তরের মানুষই তাঁর শিষ্য হতে পারত। কিন্তু যারা সৎ, পরিশ্রমী ও চরিত্রবান দরিদ্র হলেও তাদের তিনি আগ্রহের সঙ্গে শিক্ষা দিতেন। ছাত্ররা যাতে নিজেদের অন্তরের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে পারে সেই চেষ্টায় তিনি প্রাণপাত করতেন। শিক্ষক হিসাবে খ্যাতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কনফুসিয়াস মহাজ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে দেশের মানুষের সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করলেন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও দেশের কোনো রাজ দরবার তার উপদেশ বা পরামর্শের জন্য উৎসাহিত হয়নি। অভিজাত মানুষেরাও বিত্তহীন বলে তার উপদেশ ও শিক্ষায় বিশেষ কর্ণপাত করত না। অর্থ প্রতিপত্তিবিহীন কনফুসিয়াসের জীবনযাত্রাও ছিল অতি সাধারণ। তদুপরি তিনি ছিলেন অনেকটাই কুৎসিত দর্শন। অস্বাভাবিক দীর্ঘ দেহ, চওড়া মুখ ও নাক, বিশালাকৃতির মাথা মিলিয়ে তিনি ছিলেন বিরূপ-দর্শন পুরুষ। তার ওপরে পিঠ ছিল কচ্ছপের মতো। হাঁটতেও পারতেন না স্বচ্ছন্দ গতিতে। হাঁটার সময় হাত দুটি পাখির ডানার মতো দুপাশে ছড়িয়ে থাকত।
পন্ডিত বিজ্ঞ বলে মুখে স্বীকার করলেও এমন একটি বিকৃত-দর্শন দরিদ্র মানুষের উপদেশ মান্য করতে স্বভাবতঃই অভিজাত সম্প্রদায় কুণ্ঠা বোধ করতেন। ইতিমধ্যে আকস্মিক একটি ঘটনায় অভিজাত শ্রেণি কনফুসিয়াসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
কনফুসিয়াস বাস করতেন রাজধানী চু ফু শহরে। সেখানে অভিজাত সমাজের প্রধান ছিলেন বৃদ্ধ মেং। মৃত্যুকালে তিনি তার পুত্রদের বলে যান তারা যেন অবিলম্বে কনফুসিয়াসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ করে। তিনি কেবল মহাজ্ঞানী নন, মহা ধার্মিক। বৃদ্ধ মেং এর পুত্ররা কনফুসিয়াসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর থেকে অভিজাত সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই সময় পর্যন্ত ৩৮০০ জন ছাত্র তাকে শিক্ষাগুরু বলে স্বীকার করেছিলেন।
ইতিমধ্যে লু রাজ্যে দেখা দিল সামরিক বিপর্যয়। প্রতিবেশী দেশের আক্রমণের ফলে কনফুসিয়াস দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি পার্শ্ববর্তী সি রাজ্যের রাজা চিংয়ের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। রাজা চিং তাঁর পান্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন। তিনি তাকে বসবাসের প্রয়োজনীয় উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। রাজা চিং পরে রাষ্ট্রনৈতিক অনেক বিষয়েই কনফুসিয়াসের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এখানে দীর্ঘ সাত বৎসর তিনি অবস্থান করেছিলেন।
সেই সময় চিং রাজবংশের এক কর্মচারী, তার নাম ইয়ং হু, কূট কৌশলে রাজাকে বিতাড়িত করে শাসন ক্ষমতা দখল করে নেয়। কুটবুদ্ধি ও কর্মতৎপরতার বলে অল্প সময়ের মধ্যেই সে পার্শ্ববর্তী সমস্ত রাজ্য দখল করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইয়ং হু মহাজ্ঞানী কনফুসিয়াসের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাবান। সে তাকে রাজ্যের মন্ত্রীপদে আমন্ত্রণ জানান।
কনফুসিয়াস জানতেন এই নতুন রাজা তার প্রভুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাছাড়া সে পররাজ্য লোভী। রাজ্য পরিপালন করার মতো কোনো মহৎ গুণও তার মধ্যে ছিল না। এমন নীতিহীন হীন চরিত্রের মানুষকে কোনও ভাবেই সাহায্য করতে চাইলেন না তিনি। প্রত্যাখ্যান করলেন ইয়ং হুর আহ্বান। ক্ষমতালাভ করেও কনফুসিয়াসের প্রতি শ্রদ্ধাবনত ছিলেন ইয়ং। তাই তাঁর প্রত্যাখ্যানে রুষ্ট না হয়ে একাধিকবার মন্ত্রীপদ গ্রহণ করবার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি।
সাধারণ মানুষের দুঃখ মোচন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা স্থাপনের স্বার্থে কোনো রাজ্যের উচ্চ পদ লাভের আকাঙ্ক্ষা ছিল কনফুসিয়াসের। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন একজন আদর্শহীন শাসকের অধীনে থেকে স্বাধীন ভাবে রাজ্যের উন্নয়ন সাধন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাই তিনি বার বার ইয়ং-এর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
দীর্ঘ সাত বছর পরে লু রাজ্যের তরুণ সামন্ত রাজা তিং কনফুসিয়াসের কাছে প্রধানমন্ত্রী পদের আমন্ত্রণ পাঠালেন। রাজা তিং-এর সশ্রদ্ধ আহ্বান গ্রহণ করলেন কনফুসিয়াস। তাঁরই তত্ত্বাবধানে ও পরামর্শে তারপর থেকে রাজ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের কাজ চলতে লাগল। এতদিন পরে নিজের স্বপ্ন রূপায়নের সুযোগ পেলেন কনফুসিয়াস। তার উপযুক্ত পরিচালনা ও পরামর্শে অল্পদিনেই লু রাজ্যে সকল দিকে সুস্থিতি এলো। শস্য উৎপাদন ও রাজস্ব বৃদ্ধি পেল। প্রজাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যেরও উন্নতি হলো।
লু রাজ্যের উন্নতিতে অল্পদিনেই প্রতিবেশী রাজারা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লেন। তারা রাজা তিং ও প্রধানমন্ত্রী কনফুসিয়াসকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। তাদের গুপ্ত ষড়যন্ত্রের কথা দূরদর্শী কনফুসিয়াস চর মারফত আগেই জানতে পারলেন এবং কৌশলে শত্রুদের সব আয়োজন পণ্ড করে দিলেন। লু রাজ্যেও যে সকল রাজকর্মচারীর আনুগত্যের অভাব ছিল, তাদের অপসারিত করে রাজা তিং-এর প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের নিয়োগ করলেন।
সামন্ত রাজারা যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে কনফুসিয়াস তাদের অস্ত্র ও সৈন্যসংখ্যা সীমিত রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি জানতেন মানুষের মধ্যে ধর্মবোধ নীতিবোধ জাগরিত না হলে তাদের জীবন ও আচরণ হয়ে পড়বে বিশৃঙ্খল ও অসংযত। আইনের শাসনে মানুষের চরিত্রের উন্নতি বিধান করা যায় না।
সেই কারণে তিনি জনগণের নীতিবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য নানা উপদেশ দিতেন। তার এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। কনফুসিয়াসের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় সমগ্র চীন দেশের মধ্যে লু রাজ্য হয়ে উঠেছিল শান্তিসুখের স্থান। অধিবাসীরা সেখানে নির্ভয়ে ও নিরাপদে বাস করতে পারত।
কনফুসিয়াস মানুষকে যে সব ধর্মীয় উপদেশ দিতেন, নিজের জীবনেও তা সর্বাংশে পালন করতেন। রাজা তিংকেও তিনি সংযত জীবন যাপনের অনুবর্তী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কনফুসিয়াস বলতেন, একমাত্র আদর্শ রাজাই তার প্রজাদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন।
কনফুসিয়াসের সৎ উপদেশ ও শিক্ষায় রাজা তিং জীবন চালনায় নীতি অনুবর্তী হলেও একদিন শিকার যাত্রায় তার চারিত্রিক স্খলন ঘটল। এই সংবাদ জানতে পেরে মর্মাহত কনফুসিয়াস তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে লু রাজা ত্যাগ করে চলে যান। কয়েকজন মাত্র অনুগত শিষ্য এই সময় তার অনুগমন করেছিলেন।
পথে ওয়ে রাজ্যে এক ছাত্রের বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি আবার পথ চলতে লাগলেন। যখন যে রাজ্যে যান, সেখানকার রাজা তাকে অভ্যর্থনা করে প্রাসাদে নিয়ে যান। বিভিন্ন বিষয়ে তার উপদেশ ও মতামত শোনেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কোনো রাজাই তার উপদেশকে শাসনব্যবস্থায় প্রয়োগ করতেন না। এ সব ঘটনা থেকে কনফুসিয়াস উপলব্ধি করতে পারেন, তার আদর্শকে গ্রহণ করবার উপযুক্ত মানুষ কোথাও নেই। কিন্তু তিনি হতাশ হলেন না। ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে তার ছাত্রদের শিক্ষা দিতে থাকেন।
কনফুসিয়াস তার যাত্রাপথে প্রাচীন পুঁথির সন্ধান করতেন। পেলে মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। তিনি সারাজীবন ধরেই জ্ঞানের সন্ধান করেছেন। যেখানে যেমন সুযোগ পেয়েছেন, জ্ঞান আহরণ করেছেন। জ্ঞান অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে মানুষের হৃদয়কে কলুষমুক্ত করে। তাই তিনি তার ছাত্রদেরও জ্ঞান অর্জনের উপদেশ দিতেন।
তিনি বলতেন, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো দয়া ও ত্যাগ। জীবমাত্রই ঈশ্বরের সন্তান। অপরের প্রতি যখন মানুষের হৃদয়ে দয়া ও ভালবাসার জাগরণ হবে তখনই সে হয়ে উঠবে প্রকৃত মানুষ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করে সে হবে ধন্য। অর্থের লালসা মানুষকে ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এক সময় কনফুসিয়াস তার শিষ্যদের নিয়ে উপস্থিত হলেন চেন রাজ্যে। সেখানে তখন ঘোর অরাজক অবস্থা।
জনগণের দুরবস্থা দেখে তার মনে পড়ল লু রাজ্যের কথা। সেখানে নিজের নীতি ও আদর্শকে রূপ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজা তাঁকে গ্রহণ করতে পারল না। একদিন কনফুসিয়াস শিষ্যদের নিয়ে পথে বিশ্রাম করছিলেন। এমন সময় তিনখানি রথে চেপে লু রাজোর তিন রাজ কর্মচারী সেখানে উপস্থিত হলো। তারা কনফুসিয়াসকে অভিবাদন করে জানাল, মহামান্য রাজার আদেশে তারা গুরু কুংকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।
রাজ্য পরিচালনার নীতি
লু রাজ্যের রাজা ও রাজকর্মচারীরা উপলব্ধি করতে পেরেছিল, বহু ভাগ্যবলে কনফুসিয়াসের মতো উপদেষ্টা তারা পেয়েছিল। রাজ্য পরিচালনায় কনফুসিয়াসের উপদেশ অপরিহার্য। শিষ্যদের নিয়ে আবার লু রাজ্যে ফিরে এলেন কনফুসিয়াস। রাজা ও অন্যান্যরা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।
কনফুসিয়াস সশিষ্য লু রাজ্যে অবস্থান করতে লাগলেন। রাজা তার পরামর্শ মতো রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যেই লু রাজ্যের দুরবস্থার অবসান ঘটল। প্রজাদের জীবন সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এলো। রাজ্য শাসনের ব্যাপারে কনফুসিয়াস যে সব উপদেশ দিতেন সেগুলো হলো—
(১) দেশের রাজা হবে সৎ ও আদর্শবান। রাজা যদি ন্যায়ের পথে চলে তাহলে দেশের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।
(২) রাজা গরীবদের দেখাশোনার সঙ্গে বৃদ্ধ ও অশক্তদেরও সাহায্য করবে।
(৩) যোগ্যতা অনুযায়ী প্রজারা যাতে কাজ করতে পারে রাজাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(৪) রাজ্যের প্রতিটি জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে।
(৫) উন্নয়নের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের ওপর নির্দিষ্ট হারে কর ধার্য করতে হবে।
(৬) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। নিয়মিত সময়ে পুরনো রাস্তা ও সাঁকো ইত্যাদির মেরামত করতে হবে। এসব কাজ তদারকির জন্য কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে।
(৭) দেশের সর্ব ক্ষেত্রেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ধনী বা দরিদ্র কোনও প্রজাই যাতে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।[১]
কনফুসিয়াসবাদ
কনফুসিয়াসবাদ বা কনফুসীয়বাদ (ইংরেজি: Confucianism), রুইবাদ নামেও পরিচিত, প্রাচীন চীনে উদ্ভূত চিন্তা ও আচরণের একটি ব্যবস্থা। বিভিন্ন প্রকারে কনফুসিয়াসবাদকে ঐতিহ্য, একটি দর্শন, একটি ধর্ম, একটি মানবতাবাদী বা যুক্তিবাদী ধর্ম, শাসনের একটি উপায়, বা সহজভাবে জীবনযাত্রা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের (৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শিক্ষা থেকে কনফুসিয়াসবাদের বিকাশ ঘটে যাকে পরবর্তীতে ‘শতদর্শন শিক্ষায়তন’ (ইংরেজি: Hundred Schools of Thought) বলা হয়।
মূল নিবন্ধ: কনফুসিয়াসবাদ বা কনফুসীয়বাদ
কনফুসিয়াসের উপদেশাবলী মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত ছিল। প্রাচীন সমাজে তিনি কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যত পরিচিত নন তার চেয়ে চীন সমাজের সংরক্ষণকারী হিসাবেই তাঁর ঐতিহাসিক পরিচয়। মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থায় এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক কিরূপ জীবন যাপন করবে এর প্রতিটি বিষয়ে কনফুসিয়াস তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর সমস্ত উপদেশের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করা।[২]
মৃত্যু
সময়ে সময়ে রাজাকে রাজ্য শাসনের ব্যাপারে উপদেশ নির্দেশ দেবার প্রয়োজন হলেও কনফুসিয়াস বেশিরভাগ সময়ই ঈশ্বরের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। তবে শিষ্যদের উপদেশ দিতেন নিয়মিত। বয়স বাড়ছিল তার। শরীরও ভেঙ্গে পড়ছিল। একদিন কনফুসিয়াস তার শিষ্যদের কাছে ডাকলেন। সময়টা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ অব্দ। শিষ্যদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমার এবার বিদায় নেবার সময় হয়েছে। তোমরাই আমার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবে। কোনও আড়ম্বর করবে না। তাহলে আমার ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার পথে বাধা পড়বে। এর পরেই সমাধিস্থ হন তিনি এবং সেটাই ছিল তার জীবনের শেষ সমাধি।
যথাযোগ্য মর্যাদায় শিষ্যরা কনফুসিয়াসের শেষকাজ সম্পন্ন করল। তার সমাধিস্থলে মন্দির তৈরি করা হলো। মন্দিরের পাশে কুঁড়ে ঘর নির্মাণ করে শিষ্যরা বাস করলেন দীর্ঘ তিন বছর।
প্রাচীন পৃথিবীর ধর্ম উপদেষ্টাদের অন্যতম কনফুসিয়াস নতুন কোনো মতবাদ বা ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেননি। সময়ানুগ বিচারে পুরনো রীতিনীতির সংস্কার করেছিলেন তিনি। মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলতেন, মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণগুলি হলো সততা, পবিত্রতা, ভালবাসা, দয়া ও জ্ঞান। এই গুণই মানুষকে দেবত্ব দান করে। কনফুসিয়াসের মধ্যে এই সমস্ত গুণেরই সমবেশ ঘটেছিল। নতুন কোনও ধর্মমত প্রতিষ্ঠা না করেও প্রচলিত ধর্মীয় জীবনে কনফুসিয়াস ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন ধর্মবিপ্লবী।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ২য় খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৫৪-৪৬৪।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১১৮-১১৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।