প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধের কারণ এবং যুদ্ধের পটভূমি

প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ (ইংরেজি: First Sino-Japanese War; ২৫ জুলাই ১৮৯৪ – ১৭ এপ্রিল ১৮৯৫) ছিল চীনের ইতিহাসে তৎকালীন চীনা কিং রাজবংশ এবং জাপান সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রাথমিকভাবে জোসেওন কোরিয়ায় প্রভাব নিয়ে একটি সংঘাত। জাপানি স্থল ও নৌবাহিনীর ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে অবিচ্ছিন্ন সাফল্য এবং ওয়েহাইওয়েই বন্দর হারানোর পর, কিং সরকার  ১৮৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শান্তির জন্য আলোচনা শুরু করে।

১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে জাপানে মেইজ রাজতন্ত্রের “পুনঃপ্রতিষ্ঠার” (Meiji Restoration) পর জাপান শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি লাভ করে। একই সঙ্গে জাপান জাতীয় প্রতিষ্ঠা ও সামরিক শক্তির বিকাশের জন্য শক্তি নিয়োগ করে।

ক্ষুদ্র দ্বীপ জাপান সর্বদাই চীন ও কোরিয়ায় নিজের শক্তি ও প্রভাব বিস্তারের প্রতি সচেষ্ট ছিল। এই উদ্দেশ্যে জাপান ১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে চীনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোরিয়া আক্রমণ করে। জাপানের আক্রমণ এই প্রথম নয়। ১৮৭০ সাল থেকে তারা কয়েকবার কোরিয়া আক্রমণ দ্বারা তাদের কাছ থেকে বাণিজ্যের অধিকার ও কোরিয়ায় পাকাপাকিভাবে জাপানি সেনা নিয়োগ করার অধিকার অর্জন করে। কোরিয়া আংশিকরূপে জাপানের উপনিবেশে পরিণত হয়।

কোরিয়া আক্রমণের পেছনে মার্কিন উসকানি ছিল। ব্রিটেন ও রুশ দেশের মধ্যে পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে স্বার্থের সংঘাত জন্মেছিল। তাই জাপানের মাধ্যমে ব্রিটেন এই ক্ষেত্রে রুশ-প্রভাব প্রতিরোধ করতে উদ্যোগী হয়েছিল। জাপানের কোরিয়া আক্রমণের পেছনে ব্রিটেনের প্ররোচনা ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়ায় কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য কোরিয়ার শাসকরা চীনের কাছে সেনা পাঠানোর আবেদন জানান। এই সুযোগে জাপান তার জলসেনা ও স্থলসেনা নিয়ে প্রবেশ করে এবং বিদ্রোহ দমনের পরও কোরিয়ায় তাদের সেনা মোতায়েন রাখে এবং একই বছরে জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে চীনের স্থল ও নৌসেনার উপর বারবার হিংস্র আক্রমণ চালায়। চীনের নৌসেনার জেনারেল ও এডমিরাল স্থানীয় অফিসাররা প্রাণপণ লড়াই করেন। কিন্তু জাপানের তুলনায় চীনারা নৌযুদ্ধে অপেক্ষাকৃত অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ ছিলেন। তদুপরি লী হুংচাং-এর মতো উচ্চপদাধিকারী সেনাপতি ও আধিকারিকরা বলপ্রয়োগ না করার নীতি (non-resistance) অনুসরণ করেন। ফলে চীনা সেনাদের মনোবল ভেঙে যায়।

অন্যদিকে জাপানি নৌসেনা চতুর্দিক থেকে চীনাদের উপর মুহুর্মুহু আক্রমণ দ্বারা পর্যুদস্ত করে এবং উত্তর-পূর্ব চীনের বন্দর তালিয়েন (দায়রেন) ও লুমুন অধিকার করেন। জাপানি সেনা ১৮৯৫ সালের গোড়ায় উত্তর চীনের যানতুং প্রদেশের উপকূল অঞ্চলের চীনের নৌসেনাকে নিঃশেষ করে ফেলে। প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধের শেষ পরিণতি হচ্ছে ত্রস্ত চীনা সম্রাট মার্চ মাসে লী হুংচাং-এর মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে এক অপমানজনক সন্ধি করেন, যার নাম “শিমোনোসেকি সন্ধি।” 

শিমোনোসেকির সন্ধি

এই শিমোনোসেকির চুক্তি অনুসারে উপরোক্ত অধিকৃত অঞ্চল, তাইওয়ান (Taiwan) ইত্যাদি চীনের দেশাংশ জাপানের অধিকারে গেল, ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ২০ কোটি আউন্স (চীনা টায়েল) রূপা জাপান পেল এবং আরও পেল বাণিজ্য করার ও কারখানা খোলার অধিকার। এইরূপে সাম্রাজ্যবাদীরা চীনের ভূখণ্ডকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করার ষড়যন্ত্রে ব্যাপৃত থাকে।

একদা সমৃদ্ধ চীন বিদেশিদের তাঁবেদারে পরিণত হয়, আর্থিকরূপে ক্রমশ দরিদ্র দেশে পরিগণিত হয়, চীনের কৃষি ও শিল্প ধ্বংস হয়। বিদেশিদের কলকারখানাগুলির কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে ও উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারে পরিণত হয়।

তথ্যসূত্র

১. অলোক কুমার ঘোষ, “চীনের ইতিহাস”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ মে ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!