গিরিশচন্দ্র ঘোষ (ইংরেজি: Girish Chandra Ghosh;২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৪ – ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১২) ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যপরিচালক, অভিনেতা এবং সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগ তাঁরই অবদান। তিনি ১৮৭২ সালে প্রথম বাঙালি পেশাদার নাট্য সংস্থা গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, প্রায় ৪০টি নাটক রচনা করেছিলেন এবং অভিনয় ও আরও অনেক নাটকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং পরবর্তী জীবনে তিনি শ্রী রামকৃষ্ণের একজন বিখ্যাত শিষ্য হয়েছিলেন।
তাঁর জন্ম হয়েছিল কলকাতার বাগবাজারে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারী। পিতার নাম নীলকমল ঘোষ। বাল্য বয়সেই পিতা মাতাকে হারিয়ে গিরিশচন্দ্র এক প্রকার অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। ফলে পড়াশোনার বেশিরভাগ সময়টাই কাটতো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ও হুল্লোড়বাজিতে। তবে স্বভাবত প্রতিভা বলে মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলে নাটকে ভাল অভিনয়ও করতেন। পড়াশোনা শুরু হয়েছিল পাইকপাড়া স্কুলে। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির জন্য বেশিদূর এগোতে পারেন নি। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের কর্মজীবন
কুড়ি বছর বয়সে অ্যাটিকিনসন টিলকন কোম্পানিতে বুক কিপারের কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এই সময় বন্ধু ব্রজবিহারী সোমের উৎসাহে দেশী ও বিদেশী সাহিত্য পাঠে আগ্রহ জন্মে এবং প্রচুর পড়াশোনা করেন।
কৈশোরে কিছুকাল হাফ-আখড়াই গানের দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে সঙ্গীত ও অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেই সময় বাগবাজারে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে একটি থিয়েটারের দল গঠন করেন।
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে এই দলের প্রযোজনায় মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক মঞ্চস্থ হয়। গিরিশচন্দ্র এই নাটকের জন্য সঙ্গীত রচনা করেন। এই ভাবেই ভাবীকালের শ্রেষ্ঠ নট ও নাট্যকারের নাট্যজগতে আবির্ভাব ঘটে।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে বাগবাজার দল দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী অভিনয় করে। সপ্তমী পূজার রাত্রে বাগবাজারের প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে স্টেজ বেঁধে অভিনয় হয়েছিল! গিরিশচন্দ্র এই নাটকের নিমচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসা লাভ করেছিলেন। এই নাট্যসংস্থার নাম পরে ন্যাশানাল থিয়েটার হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গিরিশচন্দ্রের নেতৃত্বে সেই সর্বপ্রথম পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়।
তিনিই সর্বপ্রথম নাট্যাভিনয়কে সুচারু শিল্পরূপে এদেশে প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের অভিনয় প্রতিভাবলে অভিনয় ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতির প্রবর্তন করেন। গিরিশচন্দ্র ছিলেন নট ও নাট্যকার রূপে এক দুর্লভ প্রতিভার সমন্বয়।
অভিনয় রজনীতে টিকিট বিক্রির প্রশ্নে গিরিশচন্দ্র ন্যাশনাল থিয়েটারের সংশ্রব ত্যাগ করেন। কিছুকাল পরে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হলে গিরিশচন্দ্র তাতে যোগ দেন ও অবৈতনিকভাবে অভিনয় করেন।
পরবর্তীকালে তিনি এই প্রতিষ্ঠানেই একশ টাকা বেতনে ম্যানেজার নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই তিনি নিয়মিত নাট্য রচনা আরম্ভ করেন। তার রচিত প্রথম মৌলিক নাটক আগমনী গ্রেট ন্যাশানালের মঞ্চেই ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে অভিনীত হয়।
জীবনের পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে গিরিশচন্দ্র স্টার, এমারেল্ড, মিনার্ভা, ক্লাসিক, কোহিনূর প্রভৃতি রঙ্গশালায় পরিচালনার কাজ করেন। পরে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে মিনার্ভা থিয়েটারে অধ্যক্ষ পদে আসীন হন এবং আমৃত্যু এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
গিরিশচন্দ্র রচিত চৈতন্যলীলা নাটকের অভিনয় দেখতে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্টার থিয়েটারে আসেন এবং চৈতন্য চরিত্রের অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীকে আশীর্বাদ করে যান। এই সময় থেকেই স্বেচ্ছাচারী গিরিশচন্দ্রের জীবনে পরিবর্তনের সূচনা হয়। ক্রমে তিনি রামকৃষ্ণদেবের অনুগ্রহ লাভ করেন এবং স্বামী বিবেকানন্দকে বন্ধুরূপে পান। শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘের সংস্পর্শে এসে গিরিশচন্দ্র তার বেপরোয়া জীবনকে সংহত করেন; ঠাকুরের প্রতি অচলা ভক্তি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
তার জীবনে ঠাকুরের প্রভাব এক বিচিত্র অধ্যায়। তারই প্রকাশ ঘটে তার পৌরাণিক ও ভক্তি রসের নাটক নাটিকায়। চৈতন্যলীলা ও বিল্বমঙ্গল গিরিশচন্দ্রের আদর্শ ভক্তিরসের নাটক রূপে চিহ্নিত। ভারতীয় পুরাণের প্রধান নৈতিক আদর্শ ভক্তি নিষ্ঠা প্রভৃতি তত্ত্বগুলিকে তিনি অতি দক্ষতার সঙ্গে পৌরাণিক ভক্তিমূলক নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
গিরিশচন্দ্র বিংশ শতকের প্রথমদিকের পৌরাণিক নাট্যকার হলেও সমসাময়িক রাজনৈতিক ও স্বাদেশিক অনুরাগে কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন। সিরাজদ্দৌলা, মীরকাশিম, ছত্রপতি শিবাজী, অশোক, সত্যম প্রভৃতি তার ইতিহাসাশ্রিত নাটক।
গিরিশচন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ নাটকের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ। প্রহসন, রূপক, গীতিনাট্য প্রভৃতির সংখ্যাও প্রায় একই রকম। অভিনয়, নাট্যালয় পরিচালনা, অভিনয় শিক্ষা প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও যে শতাধিক নাটক তিনি রচনা করেছেন এতেই তার অসামান্য প্রতিভা প্রমাণ করে।
গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকগুলিতে অমিত্রাক্ষর ধরনের এক অভিনব ছন্দ ব্যবহার করেন। এই ছন্দ তারই নামে গৈরিশছন্দ নামে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তিনি নাট্যমঞ্চের প্রয়োজনে এবং নটনটীদের যোগ্যতানুযায়ী অধিকাংশ নাটক রচনা করেছেন।
উইলিয়াম শেকসপীয়রের ম্যাকবেথ নাটকের সার্থক বাংলা অনুবাদ ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাস এবং মধুসূদনের মেঘনাদ বধ ও নবীনচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ কাব্যের নাট্যরূপ দান করেছিলেন।
মেঘনাদবধ কাব্যে রাম ও মেঘনাদ উভয় ভূমিকাতেই অভিনয় করে গিরিশচন্দ্র বাংলার নাট্যামোদিদের চমৎকৃত করেছিলেন। অভিনয় শক্তিবলে সেকালে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন।
গিরিশচন্দ্রের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটক দক্ষযজ্ঞ, পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস, জনা, পাণ্ডবগৌরব, প্রফুল্ল, হারানিধি, কালাপাহাড়, আবুহোসেন প্রভৃতি।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারী গিরিশচন্দ্র ইহলোক ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৫-৪৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।