কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন (ইংরেজি: Khondakar Ashraf Hossain; ৪ জানুয়ারি, ১৯৫০ -১৬ জুন, ২০১৩) ছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার পরের যুগের উত্তরাধুনিক কবি। তিনি যখন জন্মেছিলেন তখন বাংলা কবিতার আধুনিক কালের রমরমা যুগ। সেই যুগ শেষ করার জন্য বাংলা ভাষায় যে ক’জন কবি চেষ্টা করেছিলেন তিনি তাঁদের একজন।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন আমাকে আধুনিক বাংলা কবিতা ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন। পরে আমি নিজেই কবিতা লিখতে শুরু করি। কিন্তু কোনোদিনই আমার কবিতা স্যারকে দেখানো হয়নি। এমনকি কত শত তরুণ কবি ‘একবিংশ’-তে কবিতা দিয়েছে; শুধু আমিই দেইনি। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়নি আমার কমিউনিজম প্রীতির কারণে। তিনি সমাজতন্ত্র থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন হয়তো; আর আমরা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম সেই সমাজতন্ত্রকেই।
কাব্য বিষয়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেন
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় রাজনীতি যে একেবারেই নেই তা নয়। তিনি রাজনীতি ও সমাজকে তার কবিতায় তুলে ধরেছেন খুব অল্প পরিসরে। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পার্থ তোমার তীব্র তীর বইয়ের একটি কবিতা হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা। কবিতাটির তিনটি লাইন এখানে দেয়া হচ্ছে, পাঠ বিবেচনা পাঠকের।
“কবি ও কুকুরদের এইখানে আসতে দিও না।
ফেব্রুয়ারিতে জনৈক বাগান মালিক, নির্বাচিত কবিতা, ১৯৯৭, প. ১০৪
ওদের নখরে শুধু উঠে আসে স্মৃতির কবর থেকে মৃত
ভায়ের বোনের লাশ, আমাদের সমাহিত স্মৃতির কাফন।”
সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর কাব্যগ্রন্থে কয়েকটি কবিতা তুমুল রাজনৈতিক। যেমন ‘বেহুলা বাংলাদেশ’ কবিতাটির মূল বিষয় তুমুলভাবে এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। বাংলার দামাল ‘ঐ নবীন লখিন্দর রাজপথে আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে আছে এতোদিন যে অন্যায় এবং অত্যাচার আমার উপর মানে দেশের উপর করা হয়েছে তার প্রতিশোধ'[২] নেবার জন্য রাজপথে দাঁড়িয়েছে। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শ্লোগান বুকে পিঠে লিখে রাজপথে দাঁড়িয়েছেন নূর হোসেন। কবিতাটির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,
“আমি ডুবে যাচ্ছি, ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠছি
বেহুলা বাংলাদেশ, নির্বাচিত কবিতা, ১৯৯৭, প. ১০৪
মৃত্যুর শয্যা ছেড়ে নবীন লখিন্দর, আমার বুকের ছাতি
ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে, কঙ্কালের চিহ্নগুলো ঢেকে যাচ্ছে
পেশির কবরে –
রাজপথে দাঁড়ালাম বুকে পিঠে সেঁটে নিয়ে ক্রোধ
সহস্র মৃত্যু আর অবমাননার নেবো প্রতিশোধ
নেবো প্রতিশোধ
নেবো প্রতিশোধ
একই কবিতা গ্রন্থের ‘পোশাক শিল্পের শ্রীরাধা’ কবিতাটি বন্দি নারীদের জীবনযন্ত্রণা আর কাল্পনিক স্বপ্নকে ফুটিয়ে তোলে। ‘পথরোধ চাই’ হচ্ছে ক্রোধে জ্বলে উঠবার আশায় লেখা এক প্রেম আর সৌন্দর্যের কবিতা। কবিতা কোলাজে যে বারটি ছোট কবিতা আছে তার অনেকগুলোতে আছে রাজনৈতিক চেতনার ছোঁয়া।
তাঁর লেখা ১টি লাইন বারবার মনে পড়ে ‘ভালোবাসিয়াছি, ভালোবাসিয়াছি, ভালোবাসে নাই ভালো’। তাঁর কবিতা হচ্ছে এমন এক নির্জীব বস্তু, যা থেকে কেবল শক্ত পাথরের মৃদু ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তিনি যে পাঊল সেলানের কবিতা অনুবাদ করবেন তার একটি প্রধান কারণ তিনি দুর্বোধ্যতা পছন্দ করেন। আশরাফ হোসেনের কবিতা বাংলা কবিতায় বিস্ময়করভাবে আলাদা মূলত এর বিষয়, দুর্বোধ্যতা এবং অগ্রহণযোগ্যতার জন্য।
সাহিত্য সাধনায় খোন্দকার আশরাফ হোসেন
তিনি ১৯৫০ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি লেখালেখির সংগে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর এ যাবত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’, ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’, ‘জীবনের সমান চুমুক’, ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’, ‘জন্মবাউল’, ‘যমুনাপর্ব’ এবং ‘আয়না দেখে অন্ধ মানুষ’ । ‘বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন’ তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন সফোক্লিসের ইডিপাস, ইউরিপিডিসের মিডিয়া, আলসেস্টিস, পাউল সেলানের কবিতা, এডিথ হ্যামিল্টনের মিথলজিসহ অনেক গ্রন্থ। তাঁর গবেষণার পরিমাণ বিপুল।
তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে সৃষ্টিশীল কবিতার কাগজ ‘একবিংশ’ সম্পাদনা করেছেন। পেশাগত দিক দিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ৪২ দিনের মাথায় প্রায় আকস্মিকভাবেই ২০১৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে রোববার সকালে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একজন প্রতিভাবান লেখক ও বহু বিষয়ে বিদ্বান ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছিল। ভালো থাকুক এই পৃথিবীর শ্রমিকেরা, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন খোন্দকার আশরাফ হোসেন।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, “খোন্দকার আশরাফ হোসেন আধুনিক বাংলা কবিতা পরবর্তী যুগের উত্তরাধুনিক কবি”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/ashraf-hossain/
২. অনুপ সাদি গৃহীত খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সাক্ষাৎকার, “আমাদের সমাজটা আসলে বন্দি“, ২৭ নভেম্বর, ২০০০, দৈনিক বানলাবাজার পত্রিকা, উপসম্পাদকীয় পাতা।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।