নেরুদা বা পাবলো নেরুদা (ইংরেজি: Pablo Neruda; ১২ জুলাই, ১৯০৪ – ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩) চিলির জাতীয় কবি হলেও লাতিন আমেরিকার কবি রূপেই প্রসিদ্ধ। দেশপ্রেম ও মানবতার আবেদনধর্মী কবিতার জন্য তিনি আজ সারাবিশ্বে পরিচিত। তাঁর আসল নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েজ বাসোয়ালতো (Neftali Ricardo Reyes Basoalto)।
তিনি যখন তাঁর প্রথম কবিতার বইটি লিখেছিলেন, তখন ভাবতেই পারেননি যে ভবিষ্যতে রাস্তাঘাটে, কলকারখানায়, গ্রামগঞ্জে, শহরে, থিয়েটারে, সভাসমিতিতে কিংবা প্রায় প্রতিটি প্রতিবাদ-সভায় তাঁর কবিতা তাঁকেই পাঠ করতে হবে, শোনাতে হবে সাধারণ মানুষজনকে। পাবলো নেরুদার দেশ চিলের সর্বত্রই ছড়িয়েছে তাঁর অমর কবিতা![১]
নেরুদার জন্ম চিলির পায়েলের রিকাডো গ্রামে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই। তঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে দক্ষিণ চিলির সীমান্তবর্তী শহর তেমুকাতেয়। নেরুদার পিতা যোশে কার্মেন রেয়েজ ছিলেন আরাউকে প্রদেশে নতুন নতুন রেললাইন বসাবার কাজে নিযুক্ত। সেখানকার বেশির ভাগ মানুষেরই জীবিকা ছিল পশুপালন ও কৃষি। এই সরলপ্রাণ কৃষিজীবী মানুষদের সংস্কারমুক্ত সমাজ ও ধর্মের আবহাওয়ায় এবং বন্যপ্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে নেরুদা বড় হয়ে ওঠেন।
নেরুদার মা রোজা বাসোয়ালতো ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। মাত্র তিন বছর বয়সেই নেরুদা মাতৃহারা হন। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা পুনরায় বিয়ে করে সপরিবারে চলে এসেছিলেন তেমুকোতে।
স্কুলের পড়ায় বিশেষ মনোযোগ ছিল না নেরুদার। তিনি পড়তেন বাইরের বই। জুলে ভার্ন, ভিক্টর হুগো, ওয়াল্টার স্কট, আর ম্যাক্সিম গোর্কির লেখার মধ্যে সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন। এভাবেই শৈশব থেকে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকাশের সুযোগ লাভ করেছিল।
মাত্র দশ বছর বয়সেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। এই বয়সেই কবিতার বিষয় নির্বাচনের প্রতি ছিল তাঁর সতর্ক নজর। কবিতা লেখার সুবাদে পরিচিত মহলে কবিখ্যাতি লাভ করেন ১৩ বছর বয়সের মধ্যেই। এই সময়েই তার সঙ্গে পরিচয় হয় চিলির তৎকালীন বিখ্যাত কবি গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের। গ্যাব্রিয়েলা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। নেরুদার জীবনে তার প্রেরণা গভীর রেখাপাত করেছিল।
স্কুলের পড়া শেষ করে নেরুদা ফরাসী ভাষা শেখার জন্য ভর্তি হন সানটিয়াগোর অপর একটি স্কুলে। কিন্তু তিনি নিজের সাহিত্য চর্চা নিয়ে এতই মেতে উঠেছিলেন যে পড়াশোনায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারলেন না। পনের বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাবলো নেরুদা ছদ্মনামে নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত কবি হওয়ারই স্বপ্ন দেখছেন তখন তিনি। এই বয়সে তার কবিতার বিষয় ছিল প্রেম ভালবাসা, বিরহ, মৃত্যু; এই অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সাহিত্য জীবনে নেরুদা
নেরুদার প্রথম কবিতার বই টুইলাইট প্রকাশিত হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। উৎসাহিত হয়ে তিনি পরের বছরেই প্রকাশ করলেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ veinte Poemas de amar বা কুড়িটি প্রেমের কবিতা। বয়স কুড়িতে পৌছনোর আগেই নেরুদার কবিখ্যাতি সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ততদিনে তিনি অর্জন করেছেন নিজস্ব শৈলী ও বক্তব্য। বেরিয়ে এসেছেন প্রচলিত প্রকরণ ও ঢঙ-এর গন্ডি থেকে।
কবিতার পাশাপাশি গল্প লেখাতেও হাত দিয়েছিলেন নেরুদা। তাঁর প্রথম উপন্যাস El habitante ys caperanza বা নিবাসী ও তার আশা প্রকাশিত হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে।
১৯২৭ সালে কূটনৈতিক জীবন শুরু হলে কবিতা রচনাই হয় তার এই বিচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গী। প্রবাস বাসকালীন রচনা Residencla eu latierra বা পৃথিবীর বাসা কবিতাগুচ্ছ। দেশের বাইরে থাকার যন্ত্রণা ও “একাকীত্ব” স্মৃতিমেদুরতা ছিল এই কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তু।
চিলির মহাকাব্য বলে কথিত CantoGeneral বা কান্ড সর্বময় কবিতা প্রকাশিত হলো ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিলির বামপন্থী বিরোধী আইন কিছুটা শিথিল হলে নেরুদা দেশে ফিরে এলেন। এই সময় তার কবিতার ধরন-ধারণ সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। তাঁর লেখা হয়ে উঠল সমাজের বৃহত্তর অংশের আদরণীয়। তিনি হলেন সাধারণের প্রিয় কবি।
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিয়ে হলে বিয়ের অব্যবহিত আগে এবং পরে লিখলেন অসংখ্য প্রেমের কবিতা। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলো তার প্রেম বিষয়ক সনেট শতক Cien Sonetos do amar. বয়স পঞ্চাশ উত্তীর্ণ করে কবি তার কবিতার মোড় ফিরিয়েছিলেন। বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল ভ্রমণ, রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত জীবনে সুখ-দুঃখের হিসেব নিকেশের প্রসঙ্গ।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার গীতিনাট্য Fulgar 4 muite de Joaquin Murieta বা হোয়াকিন মুরিয়েতের মহিমা ও মৃত এবং মানব প্রগতি ও সৃষ্টি সম্পর্কে অতিকথনমূলক কবিতা La eshada encendida বা জাজ্বল্যমান তরবারি।
কূটনৈতিক জীবনে নেরুদা
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে পরের বছর থেকেই শুরু হলো নেরুদার বিচ্ছিন্ন কূটনৈতিক জীবন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে পাঁচ বছরের জন্য তাকে দূতাবাসের চাকরিতে নিয়োগ করলেন চিলি সরকার। দেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্মান জানাবার এটাই ওই দেশের সরকারের প্রচলিত রীতি। নেরুদা প্রথমে গেলেন ব্রহ্মদেশ, সেখান থেকে রেঙ্গুন, তারপর কলম্বো এবং পরে জাভায় কাটালেন নিঃসঙ্গ জীবন।
চিলি সরকারের কনসাল হয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে নেরুদা গেলেন স্পেনে। বার্সিলোনা ও মাদ্রিদে এলেন জনসাধারণের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে নিহত কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা তাঁকে প্রভাবিত করলেন।
কূটনৈতিক জীবনে এসে ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হলেন রাজনীতির প্রতি। পালাবদল এলো কবিতাতেও। তার লেখায় ধ্বনিত হলো লোরকার হত্যার বিরুদ্ধে আবেগময় প্রতিবাদ। এই কারণে তাকে হারাতে হলো কনসালের পদ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর কনসাল রূপে মেক্সিকোতে কাটালেন। এই সময়েই নেরুদা মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। হয়ে উঠলেন পুরোপুরি সৈনিক।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে নেরুদা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং চিলির আইনসভা সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে যোগ দেবার পর দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসাই তাকে প্রেসিডেন্ট ভিদেলার জনস্বার্থ বিরোধী কাজের সমালোচনা করতে উৎসাহ যোগাল। এই সময় গ্রেপ্তার হবার আশঙ্কায় তাকে আত্মগোপন করতে হলো। তাঁর সরকার বিরোধী ছড়া তখন ফিরত লোকের মুখে মুখে।
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে নেরুদা বিয়ে করলেন মাতিল দে উরুতীয়াকে। বিয়ের অব্যবহিত আগে এবং পরে লিখলেন প্রেম বিষয়ক সনেট শতক।
ইতিমধ্যে চিলির রাজনৈতিক পটভূমিতে এলো পরিবর্তন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সালভাদর আলেন্দে চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। নেরুদাকে রাষ্ট্রদূত হয়ে যেতে হল প্যারিসে। এখানে অবস্থান কালেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে নেরুদা পেলেন তার সাহিত্যের সর্বোচ্চ মর্যাদার স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার। এর আগে তিনি পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার এবং লেনিন ও স্তালিন পুরস্কার।
চিলিতে গৃহযুদ্ধের মুখে মুখে রোগাক্রান্ত নেরুদা ফিরে এলেন দেশে। তার স্মৃতিকথা Conficsoque he vivido: Memorias ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত রূপ দিলেন। রোগাক্রান্ত অবস্থাতেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর চিলির প্রিয় মানুষ নেরুদা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।[২]
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২১ অক্টোবর, ২০১৭, “পাবলো নেরুদা, তুমি আছো তাই, আমরা স্বপ্ন বুনে যাই”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/pablo-neruda/
২. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।
নেরুদা খুব বড় লেখক।
বিপ্লবের কবিতা লিখে কি হবে!