কাজী নজরুল ইসলাম (ইংরেজি: Kazi Nazrul Islam; ২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ছিলেন বিশ শতকের অন্যতম জনপ্রিয় আধুনিক বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ। নজরুল বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য।[১]
১৯২০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত কলকাতা এবং পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গ উত্তাল হতে থাকে তার গানে, জীবনোচ্ছাসে, স্বদেশী আন্দোলনে ও দুর্বার প্রাণের স্পর্শে। তিনি হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রযুগেই অন্যতম ব্যক্তিত্ব। স্বীকৃতি পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।[২]
জন্ম ও শৈশবে নজরুল
ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে, বাংলা ১৩০৬, ১১ জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্ম। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও সত্যনিষ্ঠ বাক্তি। কিন্তু দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। এই দরিদ্র পরিবারে জন্মে দুঃখ দরিদ্রের সঙ্গে সমাজের অসম ব্যবস্থার বাস্তব রূপটি প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ ঘটেছিল নজরুলের বাল্যকাল থেকেই। এই সময়েই একটি বিদ্রোহী ভাব তার মনের গভীরে জন্মলাভ করেছিল এবং এই মনোভাব নিয়েই তিনি আজীবন সমস্ত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, পীড়ন ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সৈনিকের মত সংগ্রাম করে গেছেন।
শৈশবে মাতৃপিতৃহীন হওয়ায় বিদ্যাশিক্ষায় বাধা পান এবং দারিদ্র্যদীর্ণ জীবন শুরু করেন। দশ বছর বয়সে মক্তবে নিম্ন-প্রাথমিক পরীক্ষাত্তীর্ণ হন। বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবী ও ফারসী এই সময়ই তিনি শিক্ষা করেন। পরে সেখানেই এক বছর পড়ান। বাল্যকালে নজরুল অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। বাঁধাধরা নিয়মে থাকা ছিল তার স্বভাব-বিরুদ্ধ।
কর্মজীবনে কাজী নজরুল
এগারো বছর বয়সে লেটো দলে গান বাঁধতে থাকেন জীবিকার টানে। স্কুলের জীবন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন রানীগঞ্জে। এক রুটির দোকানে পাঁচ টাকা বেতনে কিছুদিন কাজ করেন।
সেখান থেকে জনৈক সহৃদয় দারোগার বদান্যতায় পুনরায় তার স্কুল জীবন শুরু হয়। তিনি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র সেই সময় শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শিয়ারশোল উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র থাকাকালীন সৈনিক হিসেবে যোগ দেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ৪৯ নং বাঙ্গালী পল্টনে। ১৯১৭-১৯ সাল তার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা দেশপ্রেম, কবিতা ও গানের উৎসমুখ খুলে দেয়।
বাহিনীর সঙ্গে তাকে চলে যেতে হয় করাচীতে। শুরু হলো নজরুলের সৈনিক জীবন, সেই সঙ্গে তার কবি জীবনও। করাচীর সেনানিবাসেই দীওয়ান-ই-হাফেজ-এর কিছু রুবাই বাংলায় অনুবাদ করেন। রিক্তের বেদন বই-এর গল্পগুলিও আরব সাগরের বিজন বেলায় বসে লেখা। গান, গল্প, কবিতা সে সময়ে অজস্র ধারায় নজরুলের লেখনী থেকে বেরিয়ে আসে। তিনি সেসব লেখা পাঠিয়ে দিতেন বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
যুদ্ধক্ষেত্রে লেখা রচনাগুলির শেষে লেখা থাকত হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম। ফলে হাবিলদাব কবি নামেই তিনি প্রথম জীবনে পরিচিত হয়েছিলেন। তদানীন্তন সওগাত পত্রিকায় নজরুলের লেখা বাউন্ডুলের আত্মকাহিনীতে তার জীবনের ছাপ অনেকটাই পাওয়া যায়।
প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত নজরুলের কবিতার নাম মুক্তি, ১৩২৬ বাংলা সনে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ছাপা হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায়। সেই বছরই তখনকার অভিজাত পত্রিকা প্রবাসীর পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় হাফেজ-এর একটি রুবাইয়াৎ-এর অনুবাদ।
একই বছরে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয় ব্যথার দান ও হেনা গল্প। এই প্রেমের গল্প দুটিতে নজরুলের দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিক বোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিলে ৪৯নং বাঙালী পল্টন ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুল কলিকাতায় আসেন। নতুন বেগ সঞ্চারিত হয় নজরুলের কাব্যচর্চায়। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের কবি খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিদ্রোহী কবি রূপে তিনি স্বতঃস্ফুর্ত অভিনন্দন লাভ করেন দেশবাসীর কাছে।
মে ভুখা হু শীর্ষক প্রবন্ধ ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশের পর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারী রাজদ্রোহের অভিযােগে নজরুলের একবছর সশ্রম কারাদন্ড হয়।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রচ্ছদপট এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কারা বাসকালে জেল কর্তৃপক্ষের নির্মম আচরণের প্রতিবাদে বিদ্রোহী কাজী নজরুল হুগলী জেলে অনশন শুরু করেন। এই সময়ে বিখ্যাত গান ‘এই শিকল পরা ছল’সহ ভাঙ্গার গান, সেবক,মরণবরণ গানগুলি রচনাকরে গলা ছেড়ে গেয়ে বন্দিদের প্রাণে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন।
নজরুলের অনশনের সংবাদে দেশের সর্বত্র ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে জনরােষ ছড়িয়ে পড়ে। শিলং থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার করলেন, “Give up hunger strike, our literature claims you,”। জেলের কর্তৃপক্ষ সেই তারবার্তা নজরুলের হাতে দেন নি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র, আবদুল্লা সুরাবর্দী প্রমুখ দেশমান্য বাক্তিদের অনুরােধ বিফলে গেল। উনচল্লিশ দিন অনশনের পর জনমতের চাপে ও রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে ইংরাজ সরকার বন্দিদের দাবী মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। নজরুল চল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করেন।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল, বৈশাখ, ১৩৩১ সন, কাজী নজরুল প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই বছরেই প্রকাশিত হয় বিষের বাঁশী। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয় ঘটে। কবির কণ্ঠে ‘চরকার গান’ শুনে গান্ধী মুগ্ধ হন।
নিরন্তর দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেও নজরুলের সাহিত্য সাধনা ছিল অবিরাম। একের পর এক কবিতা, গান, প্রবন্ধ রচনা করে তিনি বাংলার সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেই সময় কবি কৃষ্ণনগরে। লিখলেন কান্ডারী হুঁশিয়ার। কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে এই গানটি গাওয়া হয়। দেশবন্ধুর স্বরাজ পার্টির সম্মেলনে ওই সময়েই লিখে কবি গাইলেন ‘ওঠরে চাষী জগৎবাসী ধর কসে লাঙল’।
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে বিদ্রোহী কবি নজরুলের আবির্ভাব। কবিতায়, গানে, প্রবন্ধে, নিজের উদার জীবন চর্চা, নির্ভীকতা ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের উজ্জ্বল প্রতীকরূপে জাতির জীবনে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে জগত্তারিণী পদক পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার পদ্মভূষণ উপাধি দেন।
সবাক চলচ্চিত্রের সূচনা পর্ব থেকেই নজরুল বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ধ্রুব, বিদ্যাপতি, সাপুড়ে প্রভৃতি ছবির সঙ্গীত রচনার সঙ্গে কাহিনীও তিনি রচনা করেছিলেন।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল-জায়া প্রমীলা পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যান। কয়েক বছর পরে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কবি নিজেও পক্ষাঘাতে বোধশক্তি হারিয়ে নীরব নির্বাক হয়ে যান। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে চিকিৎসার জন সস্ত্রীক নজরুলকে ইউরোপ পাঠানো হয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিবর রহমান কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে নীরব কবি আর স্বর ফিরে পাননি। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে শহীদ দিবসে নজরুলকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুন চিরবিদ্রোহী নজরুল ঢাকাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেখানেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে কবরস্থ করা হয়।[৩]
তথ্যসূত্র
১. দোলন প্রভা, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮, “কাজী নজরুল ইসলাম আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/kazi-nazrul-islam/
২. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা গান, প্যাপিরাস, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা, ১৬৭-১৬৮।
৩. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৪০-৪৩।
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।