সুনির্মল বসু (ইংরেজি: Sunirmal Basu; ২০ জুলাই ১৯০২ – ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭) ছিলেন বাংলা ভাষার শিশু সাহিত্যিক, লেখক ও সম্পাদক। যে কজন মুষ্টিমেয় সাহিত্য সাধক আজীবন বাংলা শিশুসাহিত্যের সেবায় ব্রতী ছিলেন তাঁদের মধ্যে কবি সুনির্মল বসু অন্যতম। বাংলার শিশু কিশোরদের মধ্যে একাধারে শিক্ষা ও আনন্দ বিতরণের ব্রত নিয়ে আজীবন অশেষ ক্লেশ স্বীকার করেও কখনো পশ্চাদপদ হননি সুনির্মল। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও জীবনী গ্রন্থ বাংলা শিশু সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হয়ে রয়েছে। “সবার আমি ছাত্র” হচ্ছে তাঁর একটি বিখ্যাত ছড়া।
সুনির্মল বসুর আদি নিবাস ছিল ঢাকায়। পিতার নাম পশুপতি বসু। তার পিতামহ গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। শিশুসাহিত্য রচনা করেও তিনি খাতি লাভ করেছিলেন। সুনির্মলোর মাতামহ বিপ্লবী মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতাও ছিলেন সুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। এই দুই পরিবারের সাহিত্য প্রতিভা সুনির্মল লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। পিতার কর্মস্থল বিহারের গিরিডিতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই।
সাঁওতাল পরগনার পাহাড়, নদী জঙ্গল সুনির্মলের শিশু মনকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করত। এখানকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে লালিত হয়ে তার কবি প্রতিভা বিকাশ লাভ করেছিল।
বন জঙ্গলের বিচিত্র পাখির কূজন, ঝরনা ধারার কুলুকুলু ধ্বনি কিশোর সুনির্মলের কবিতা রচনার প্রধান প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। প্রকৃতির বুকের ছন্দময় বিচিত্র ধ্বনির মধ্যেই তার বিচিত্র ছন্দ শিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল। পরবর্তীকালে কবিতায় বিভিন্ন ছন্দের সার্থক প্রয়োগ তাকে যশস্বী করেছিল।
কিশোর বয়সে কবিতা রচনার সঙ্গে চিত্রাঙ্কনও শিক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজেও পাঠ নিয়েছিলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় আসেন। সেন্ট পলস কলেজে পড়ার সময়েই মোহনদাস গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ফলে কলেজের পড়া অসমাপ্তই থেকে যায়।
শিশু-সাহিত্য রচনাকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সে যুগে কেবল সাহিত্যকে নির্ভর করে বিশেষ করে অবহেলিত শাখা শিশু-সাহিত্যের সেবা করে বেঁচে থাকা ছিল দুঃসহ কৃচ্ছতা ভোগের নামান্তর। বাংলার শিশু-কিশোরদের স্বার্থে সেই দুঃখময় জীবনই তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন।
সুনির্মল বসুর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। প্রথম প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থের নাম হাওয়ার দোলা। সারাজীবনে অসংখ্য সরস ছড়া, কবিতা, গল্প কাহিনী, উপন্যাস, রূপকথা, ভ্রমণকাহিনী, কৌতুকনাট্য প্রভৃতি রচনা করে শিশুসাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।
এছাড়া বহু শিশু গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন তিনি। তৎকালীন সময়ের একমাত্র কিশোর পাক্ষিক পত্রিকা কিশোর এশিয়ার তিনি পরিচালক ছিলেন। ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে শিশুসাহিত্য রচনার জন্য ভুবনেশ্বরী পদক পান। দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের শিশু-সাহিত্য শাখার সভাপতিত্ব করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছানাবড়া, পাততাড়ি, মরণের ডাক, আনন্দ নাডু, কিপটে ঠাকুর্দা, ছন্দ শিক্ষার বই, ছন্দের টুংটাং ও ছন্দের গোপন কথা, বীর শিকারী প্রভৃতি। সম্পাদিত গ্রন্থ ছোটদের চয়নিকা ও ছোটদের গল্প সঞ্চয়ন। জীবন খাতার কয়েক পাতা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থ। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারী কবি সুনির্মল বসু পরলোক গমন করেন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৮৫-৮৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।