কমরেড এম. এ. মতিন বা মোহাম্মদ আবদুল মতিন (২০ নভেম্বর, ১৯৬০ – ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) ছিলেন আজীবন বিপ্লবী, শ্রমিক ও কৃষক নেতা, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বুদ্ধিজীবি, কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, কমরেড সিরাজ সিকদারের একনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি শোষণ বৈষম্যহীন সমাজ তথা সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী লক্ষ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল ছিলেন।
কমরেড মতিন ব্যক্তিগত স্বার্থকে সমষ্টিগত স্বার্থের কাছে বিসর্জন দিয়ে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি দরিদ্র মানুষের স্বার্থে একাত্ম থাকার জন্য সচেতনভাবে বস্তি জীবন বেছে নিয়েছিলেন। অনাহার চিকিৎসাহীন আশ্রয়হীনভাবে থেকেও সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সাথে আপোষ করেননি। বাইরে থেকে দরদ দেখানো নয়, নিপীড়িত মানুষের জীবনের সাথে জীবন মিলিয়ে তাদের মুক্তির লড়াইয়ে থাকার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।[১]
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা
কমরেড এম. এ. মতিনের পিতা ছিলেন মো. ইসহাক আলী ব্যাপারী, মাতা মোছাম্মত জমিলা বেগম। তাঁর গ্রাম ছিলো মধ্য দাপুনিয়া, পো. দাপুনিয়া, সদর, ময়মনসিংহ। তাঁর জন্ম হয় ২০ নভেম্বর, ১৯৬০ নিজ ইউনিয়নস্থ গোষ্টা গ্রামে মাতুলালয়ে।
কমরেড এম এ মতিন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন মধ্য দাপুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে। মুক্তাগাছা থানাধীন খুকশিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যরনরত অবস্থায় ১৯৭২ সনে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৭৩ সনে স্কুল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যেই, বিপ্লবী ধারার কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সনে ছাত্র সংসদে সাধারণ সম্পাদকের (জি.এস.)-এর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের মাধ্যমে শূন্য পদে ঐ পদের দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবনে এম এ মতিন
এম এ মতিন দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৩ এপ্রিল ১৯৭৫ সনে হালুয়াঘাট থানাধীন জনৈক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন। সে সময় হালুয়াঘাট থানার পুলিশ ও সশস্ত্র যুবলীগ যৌথভাবে হামলা চালায়। কয়েক ঘন্টা সশস্ত্র লড়াইয়ে অনেকে গ্রেফতার এড়ালেও ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং কমরেড মতিন গ্রেপ্তার হন। তিনি একনাগাড়ে ৮ বছর বন্দী জীবন কাটান। ১৯৭৮ সনে জেল জীবনে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল হতে এস.এস.সি (প্রাইভেট) ও ১৯৮৪ সনে আনন্দমোহন কলেজ হতে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে জেল থেকে মুক্তি পান।
কমরেড মতিনের ইচ্ছা ছিল জেল থেকে মুক্ত হয়ে লেখাপড়া করবেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখেন বাবার পাটের ব্যবসার পুঁজি এবং গ্রামের নিজেদের ফসলী জমি ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে শেষ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে সংসারে হাল ধরতে স্থানীয় বাজারে কয়েক মাস মুদি দোকানদার হিসেবে ব্যবসা করেন।
১৯৭৫ এর প্রথমার্ধে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমন্ডার, ই.পি.আর খোরশেদ ও কতিপয় বিপ্লবীরা মুক্তাগাছার সৈয়দ গ্রামে অবস্থান করা অবস্থায় মুক্তাগাছা থানার পুলিশ হামলা চালায়। ঐ হামলাতে মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী কমান্ডার বাবু মান্নান ও বাড়ীওয়ালা বি.ডি.আর নূরুল আমীন শহীদ হন এবং একজন পুলিশ নিহত হয়। বাড়ীওয়ালা নিজাম উদ্দিন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে মারা যান, অন্যান্যরা আহত অবস্থায় গ্রেফতার এড়ান। গ্রেফতার এড়ানো ব্যক্তিদের মাঝে সন্দেহ করে উনাকে খুঁজতে থাকায় গোপন জীবনে চলে যান এবং টঙ্গী নিশাদ জুট মিলে শিশু বদলী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ নেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সেনা ও পুলিশ যৌথ বাহিনী টঙ্গী স্টেশন সংলগ্ন বাসায় গভীর রাতে হামলা চালায়। সে সময় ৫টি রুমের সব বিপ্লবী শ্রমিকদের নিয়ে কৌশলে গ্রেফতার এড়ান। পরদিন চাকুরী ছেড়ে এলাকা ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ জুট মিল বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতি বদলে যায় এবং জুট মিলের শ্রমিকদের নিয়ে মিল রক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিপ্লবী রাজনীতির সংস্পর্শে তাঁর ব্যক্তি জীবনে যে উন্নত নৈতিকতা বোধের জন্ম হয়েছিল, সেই উপলব্ধিতে তিনি ১৯৯০ দশকের শুরুতে পুনরায় বিপ্লবী ধারার অন্যান্য শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন এবং বস্তি গড়ে তোলা ও বস্তিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন দ্বিতীয় জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের মতাদর্শিক বিভক্তিতে দ্বিতীয় জাতীয় কমিটির পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন। পরবর্তী এক দশকে কমিটির সবাই ব্যক্তি জীবনে চলে যাওয়ায় তিনি শূন্য দশক জুড়ে বিভিন্ন প্রতিকুলতার এবং প্রতি পদে হিঃস্রতা এড়িয়ে প্রবল দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সংগঠনের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করেন এবং সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চে ২০১০ সনে যোগদান করেন এবং কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন।
মৃত্যুকালে এম এ মতিন
কমরেড এম. এ. মতিন ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ সেপ্টেম্বর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। কমরেড এম. এ. মতিনের স্মরণে শোকসভা ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর শুক্রবার বিকেলে ময়মনসিংহ শহরের বামপন্থী এলাকা হিসেবে খ্যাত মালগুদামস্থ সিপিবি কার্যালয় প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে কমরেড মতিনের সহধর্মিনী মরিয়ম বেগমসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য বলেন, তাঁদের নিজেদের একটি সন্তানও নেই। তাইতো সমাজের প্রতিটা শিশুর উপর এতো দরদ! তাদের আপদে বিপদে ছুটাছুটি। সেতো সমাজের কথা। আদর্শের কথা। কিন্তু সকল আশা ভরসা, মান অভিমান, স্বপ্ন বাস্তব যার একটি মানুষকে ঘিরে সেই স্বামীর চলে যাওয়া কিরকম বেদনার? কেমন এ ব্যকুলতা? তিনি আর কখনই আসবেন না। এটাই যে নির্মম সত্য। এ স্বামীটাকে যে কত মানুষ ভালবাসে, কত মানুষের অন্তরে তিনি ছিলেন সেটা স্বামীর মৃত্যুর পর বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি সহধর্মিনী মরিয়ম বেগমের। এরকম গর্ব কতজন স্ত্রীর থাকে? এ গর্ব কিছুটা হলেও স্বামী হারানোর কষ্টটাকে আড়াল করতে পারে। কান্নাজড়িত কন্ঠে সেই স্মৃতিচারণই করেছেন প্রয়াত কমরেড মতিনের সহধর্মিনী মরিয়ম বেগম।
লেখক এম এ মতিন
১৯৭১ সনে প্রথম কবিতা লেখেন, প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সনে ময়মনসিংহ কারাগারে বিপ্লবী বন্দীদের হাতের লেখা সংকলনে। সম্ভবতঃ ১৯৮২ সনে দৈনিক দেশ পত্রিকায় প্রথম কবিতা ছাপা হয়।
শিক্ষক বদিউল আলম লিটন কমরেড মতিনের ২০০১ সালে রচিত একটি গণসংগীতের অংশবিশেষ স্মরণ করেন। এম এ মতিন একটি গানে লিখেছিলেন,
“বিশ্ব জনতার জোট বেঁধে লও
নতুন ঐক্যের বাঁধ গড়তে
জাগ্রত হোক মজলুম মজলুম নি:স্ব
শত্রুর সাথে লড়তে।
ভেঙ্গে ফেল বেষ্টিত বেরিকেড
ধ্বংস হোক শত্রুর শক্ত রেইড
সাম্যবাদের জয় হবেই একদিন
নিশ্চিত আমরা জানি।
মাওবাদীরা মরেনি।”
কমরেড এম এ মতিনের প্রভাব
কমরেড এম এ মতিনের প্রভাব ময়মনসিংহ জেলার সাম্যবাদী আন্দোলনে চোখে পড়ে। তার মৃত্যুর পরে যে শোকসভা হয় সেই স্মৃতিচারণে উঠে আসে এক লড়াকু মানুষের বহুবিধ সংগ্রামী দিক। কমরেড এম. এ. মতিন শোকসভা আয়োজন কমিটির ব্যানারে তপন সাহা চৌধুরীর সভাপতিত্বে উক্ত শোকসভায় কমরেড মতিনের স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন মার্কসবাদী লেনিনবাদী মাওবাদী নেতাকর্মীগণ।
কমরেড এম এ মতিনের কর্মময় জীবনকে স্মরণ করে আলোচনা করেন মার্কসবাদী রবীন্দ্র গবেষক, দেশের অন্যতম প্রধান মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বুদ্ধিজীবি সৈয়দ আবুল কালাম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহবায়ক হামিদুল হক, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের আহবায়ক মাসুদ খান, সিপিবির জেলা সম্পাদক এমদাদুল হক মিল্লাত, নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার কেন্দ্রীয় সদস্য প্রফেসর মাহমুদুল আমীন খাঁন, গণমোর্চার জেলা আহবায়ক বিকাশ ভৌমিক, বাসদের জেলা সমন্বয়ক আ ন ম খায়রুল বাশার জাহাঙ্গীর, বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির জেলা সমন্বয়ক শেখর রায়, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের জেলা সভাপতি শেখ আবেদ আলী, শহীদ বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক স্মৃতিসংসদের কেন্দ্রীয় সদস্য বিজন সম্মানিত, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা তোফাজ্জল হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির আজহারুল ইসলাম, ক্ষেতমজুর সমিতির জেলা সভাপতি সুশান্ত দেবনাথ খোকন, বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা রতন সম্মানিত, গণমোর্চার নেতা ফরিদুল ইসলাম ফিরোজ।
এছাড়াও আলোচনা করেন শোকসভা আয়োজন কমিটির সদস্য সচিব মাওবাদী বুদ্ধিজীবি আধ্যাপক অনুপ সাদি, নাগরিক ঐক্যের জেলা আহবায়ক এডভোকেট নজরুল ইসলাম, বুদ্ধিজীবি ও কবি কাজী সালাহ উদ্দিন মুকুল, সাবেক বাসদ নেতা শামসুল হোসেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাবেক ছাত্রনেতা এরশাদুজ্জামান, ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের আহবায়ক কবি খালেদ হোসেন, কালিবাড়ী চরের বস্তি বাসিন্দাদের পক্ষে মজিদা বেগম, কমরেড মতিনের বাল্য বন্ধু শিক্ষক আতাউর রহমান খোকা। শোকসভা পরিচালনা করেন বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় আহবায়ক, গণমোর্চার নেতা আবুবকর সিদ্দিক রুমেল।[২]
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ৩ আগস্ট ২০১৭, “এম এ মতিন ছিলেন মার্কসবাদী বিপ্লবী, বুদ্ধিজীবি, কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/m-a-matin/
২. কমরেড এম এ মতিনের শোকসভার খবর প্রকাশের তারিখ ৫ অক্টোবর, ২০১৩, প্রাণকাকলিতে। সে সময় তার একটি জীবনী লিখে একই ব্লগে প্রকাশ করা হয়। ফুলকিবাজে দুটোকে একত্রে করে তাঁর জীবন সম্পর্কে একটি লেখা তৈরি করা হয়েছে।
শুনুন কমরেড এম এ মতিনের কণ্ঠে তারই লেখা কবিতা
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।