অতুলপ্রসাদ সেনের রচিত বাংলা গান (ইংরেজি: Songs of Atul Prasad Sen) হচ্ছে এমন একটি বিশিষ্ট সঙ্গীত রীতি যা অতুলপ্রসাদী সুর নামে সুখ্যাত। বাংলা সংগীত জগতে রামপ্রসাদ সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে যার নামটি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় তিনি অতুলপ্রসাদ সেন। অতুলপ্রসাদ সেন রচিত গানগুলির মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তিমূলক ও প্রেম। নিজের জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তার গানের ভাষায় বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছিল।[১]
সঙ্গীতই ছিল অতুলপ্রসাদের প্রাণের আরাম। নিজের রচিত গানে নিজেই সুর যোজনা করতেন। বাংলার বাউল ও কীর্তনের সুরের সঙ্গে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের সুর ও ঢঙ মিশিয়ে তিনি নিজস্ব সঙ্গীতরীতির প্রবর্তন করেছিলেন। তাই সুপরিচিত অতুল প্রসাদী সঙ্গীত-রীতি।
অতুলপ্রসাদের রচিত গানগুলিকে প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। তা হলো স্বদেশী সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান। তাঁর স্বদেশী সঙ্গীতগুলি স্বদেশ আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। জাতীয় চেতনা জাগরণে তার ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী, বল বা বল সবে শত বীণা বেণু রবে, আ-মরি বাঙলা ভাষা’, প্রভৃতি গানগুলির অবদান অপরিসীম।
সারাজীবনে প্রায় দুশত গান রচনা করেন। তাঁর গানগুলি সংগৃহীত হয় ‘কয়েকটি গান’ ও ‘গীতিগুঞ্জ’ সংকলনে। সমস্ত গানের স্বরলিপি প্রকাশ করেন কাকলি নামের গ্রন্থমালায়।
প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন সংগঠকদের মধ্যে অতুল প্রসাদ ছিলেন অন্যতম প্রধান। সম্মেলনের মুখপত্র উত্তরার তিনি ছিলেন অন্যতম সম্পাদক। সম্মেলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনে তিনি সভাপতি হয়েছিলেন। কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গেও তিনি এককালে যুক্ত হয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌ শহরে তার জীবন কাটে সফল আইনবিদ রূপে, গান গেয়ে ও রচনা করে, সমাজ ও দেশের নানা হিতকর কাজে।[২]
অতুলপ্রসাদ সেনের সংগীতসাধনা:
তার জনপ্রিয়তা ও প্রতিষ্ঠা সেখানে এতটাই ছিল যে জীবিতকালেই তার বাসস্থান সন্নিহিত সরণি তার নামাঙ্কিত হয়। বাংলা গানে অতুলপ্রসাদ এক নতুন রীতির জনয়িতা।
উত্তরভারতীয় ঠুংরির চালে এবং সেখানকার দেশজ গান, যেমন কাজরি, চৈতি, সাওয়ন, হোরী, লাউনি-র ধারায় তিনি এমন সব বাংলা গান বাঁধেন যা বাঙালী সংগীতরসিকদের রসরুচিকে অভিনব সুষমায় আকৃষ্ট করে।
সেইসঙ্গে তার জন্মার্জিত সংস্কার বাউলকীর্তন-ভাটিয়ালির ত্রিধারা মিশে অতুলপ্রসাদ সেনের রচিত বাংলা গান হয়ে ওঠে বাঙালীর সংগীত ঐতিহ্যের এক নবীন প্রসারণ। কখনও কখনও তার গানে ঝলকে ওঠে বিদেশী সুরের বিভাময় বৈচিত্র্য। মাত্র দুইশত আটখানি গান লিখে তিনি যেচিরন্তনতার আসন পেয়েছেন দেশের সৃজনক্ষেত্রে তা উদাহরণ হিসাবে অনন্য।[৩]
অতুলপ্রসাদ সেনের রচিত বাংলা গান ও বিষয়বস্তু:
বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সঙ্গীতের এক অতি পরিচিত নাম অতুল প্রসাদ সেন যার গানগুলি মূলত স্বদেশি সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান; এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে তার ব্যক্তি জীবনের বেদনা সকল ধরনের গানেই কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তার অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণ-রস প্রধান।
রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের স্নেহধন্য, দিলীপকুমার-ধূর্জটিপ্রসাদ-রতনঝংকারের প্রীতিবদ্ধ অতুলপ্রসাদ পূর্ব ও উত্তরভারতের সংগীত-সংস্কৃতির যুক্তবেণী রচনা করেছেন। তার মধ্যে মার্গ ও লৌকিক গানের আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায়।
সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার ব্যক্তিজীবনের করুণ রঙিন বেদনাবোধের অন্তঃশীল গূঢ়তা। সেই জন্যই অতুল প্রসাদের গানে আমরা পাই, আধুনিক জীবনের দ্বন্দ্বজটিল অস্তিত্ব, তার সন্তাপ ও অন্তর্দাহ। যেন আমাদের অন্তরদীর্ণ বেদনার বাণীরূপ তার গান । আমাদের বড় আপন গর্বের সামগ্রী।[২][৩]
বাংলা সঙ্গীত জগতের অন্যতম স্মরণীয় প্রতিভা অতুলপ্রসাদের অন্যতম সুবিখ্যাত দেশাত্মবোধক গানের কিয়দংশ—
হও ধরমেতে ধীর
হও করমেতে বীর
হও উন্নত শির, নাহি ভয়।
ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান
হও সবে আগুয়ান,
সাথে আছেন ভগবান, হবে জয়।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান,
দেখিয়া ভারতে মহাজাতির উত্থান
জগজন মানিবে বিস্ময়।
জগজন মানিবে বিস্ময়।
তথ্যসূত্র
১. দোলন প্রভা, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ “অতুলপ্রসাদ সেন উনিশ শতকের বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/biography/atul-prasad-sen/
২. প্রধান সম্পাদক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সম্পাদক অঞ্জলি বসু (দ্বিতীয় মুদ্রণ: ২০১৩)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খন্ড)। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ পৃষ্ঠা ১৩-১৪ আইএসবিএন 978-81-7955-135-6।
৩. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, আধুনিক বাংলা গান, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১ বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা উনিশটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।