নবীনচন্দ্র সেন (ইংরেজি: Nabinchandra Sen; ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৭ – মৃত্যু: ২৩ জানুয়ারি, ১৯০৯) ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি ও লেখক, যাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনের পূর্বে প্রায়শই একজন সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিনি পলাশীর যুদ্ধ এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসনের আগমনের বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে সেটা হচ্ছে “এক অনন্ত বিষাদের রাত”।
কবি নবীনচন্দ্রের জন্ম হয় ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের নোয়াপাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম গোপীমোহন সেন। চট্টগ্রাম স্কুল থেকে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর কলকাতায় আসেন। ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে এফ. এ এবং ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল সেমব্লীজ ইনসটিটিউশন থেকে বি.এ পাশ করেন।
ছাত্রাবস্থায় নবীনচন্দ্র সেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহচর্যে আসেন এবং তার অকুণ্ঠ সাহায্য লাভ করেন। ছাত্রাবস্থাতেই সাহিত্য জীবনের শুরু। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় এডুকেশন গেজেট পত্রিকায়। এই পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন।
কলেজের পড়া শেষ করে নবীনচন্দ্র শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেন। কর্মজীবন শুরু হয় হেয়ার স্কুলে। কিন্তু বেশিদিন এই কাজে থাকতে হয়নি। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ লাভ করেন।
এই পদে কর্মরত অবস্থায় তাকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে। কর্মজীবনের শেষ দিকে তিনি ১৮৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে রানাঘাটের মহকুমা শাসক হয়ে আসেন। সেই সময়ে তিনি নিজের উদ্যোগে তার অগ্রজ আর এক মহাকবি কৃত্তিবাসের ভিটের সন্ধান করে বঙ্গবাসীকে চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেন।
মহাকবির জন্মভিটা ফুলিয়া নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। নবীনচন্দ্র সেই ভিটে খুঁজে বার করেন। অবশ্য তাকে এই কাজে সাহায্য করেছিল রানাঘাট, শান্তিপুর ও ফুলিয়ার বিদ্বৎসমাজ। পরবর্তী সময়ে এই স্থানেই মহাকবির স্মৃতিফলক স্থাপিত হয়।
নবীনচন্দ্র সেনের সাহিত্যচর্চা
স্বদেশপ্রেম ও আত্মচিন্তামূলক কবিতার সংকলন অবকাশরঞ্জিনী নবীনচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রকাশিত হয় ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে। নবীনচন্দ্রের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ পলাশীর যুদ্ধ প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে। এই গ্রন্থ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পলাশীর প্রান্তরে বাঙ্গালী তথা ভারতবাসীর পরাজয়ের মাধ্যমে ইংরাজ ভারতভূমিতে রাজ্যশাসনের অধিকার হস্তগত করেছিল এই কাহিনী কবি এমনভাবে ব্যক্ত করেছিলেন যে তা দেশবাসীকে স্বাদেশীকতায় উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল।
নবীনচন্দ্র দেশ প্রেমিক কবি হিসাবে খ্যাতি লাভ করলেন। এর ফল হলো, নবীনচন্দ্রকে তার উর্ধ্বতন রাজকর্মচারির বিরাগভাজন হতে হলো।
ইতিমধ্যে রৈবতক, কুরুক্ষেত্র ও প্রবাস প্রকাশিত হলে নবীনচন্দ্রের কবিখ্যাতি আরও বৃদ্ধি পায়। এই তিন কাব্যগ্রন্থে তিনি মহাভারতের ঘটনার মৌলিক ব্যাখ্যা করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কবি কর্মস্থল থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সর্বমোট চোদ্দটি গ্রন্থ নবীনচন্দ্র রচনা করেন। তার মধ্যে ক্লিওপেট্রা, ভানুমতী, প্রবাসের পত্র ও অমিতাভ উল্লেখযোগ্য। আমার জীবন তার আত্মজীবনী। এই গ্রন্থে তৎকালীন সময়ের অনেক অজ্ঞাত কথা জানা যায়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে নবীনচন্দ্র পরলোক গমন করেন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৯-৫০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।