কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত হচ্ছে দেশপ্রেম, প্রেম, ধর্মসংগীতসহ রাগ ধারার

কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত (Songs of Kazi Nazrul Islam) হচ্ছে দেশপ্রেম, প্রেম, ধর্মসংগীতসহ রাগ ধারার বহুমুখী গান। তাঁর এই গানের প্রতিভা শৈশব থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত বিরাজিত ছিল। বাল্যকালেই চুরুলিয়ার পল্লী কবিদের প্রতি নজরুল অনুরক্ত হন। তিনি নিজেও মুখে মুখে কবিতা রচনা করে পল্লীবাসীদের প্রশংসা অর্জন করেন। এগারো বছর বয়সে লেটো দলে গান বাঁধতে থাকেন জীবিকার টানে। ১৩-১৪ বছর বয়সে নজরুল উর্দু গজল গেয়ে কবিগানের আসর জমিয়ে শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বাল্য বয়সেই লেটো দলের জন্য চাষার সং, শকুনি বধ পালাগান রচনা করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম যতদিন সুস্থ ছিলেন ততদিন গান লিখেছেন এবং গান গেয়েছেন। সারা জীবনে প্রায় ৩ হাজারের মতো গান লিখেছেন। কারা বাসকালে জেল কর্তৃপক্ষের নির্মম আচরণের প্রতিবাদে বিদ্রোহী নজরুল হুগলী জেলে অনশন শুরু করেন। এই সময়ে বিখ্যাত গান ‘এই শিকল পরা ছল’সহ ভাঙ্গার গান, সেবক,মরণবরণ গানগুলি রচনাকরে গলা ছেড়ে গেয়ে বন্দিদের প্রাণে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে মোহনদাস গান্ধীর সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয় ঘটে। কবির কণ্ঠে ‘চরকার গান’ শুনে গান্ধী মুগ্ধ হন।[১]

বহুমূল্যবান রসোত্তীর্ণ কাব্য স্রষ্টা, অসংখ্য গানের রচয়িতা ও সুরকার নজরুল ইসলামের পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে তারই একটি ভাষণে। বাংলা ১৩৪৭, চৈত্র মাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “দুঃখ সয়েছি, আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করেছি কিন্তু আত্মার অবমাননা করিনি। নিজের স্বাধীনতাকে কখনো বিসর্জন দিইনি। বলবীর চির উন্নত মম শির—একথা আমি আমার অনুভূতি থেকেই পেয়েছি।”

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে নজরুল ব্রিটিশ গ্রামােফোন কোম্পানিতে কাজ পান। প্রথমে গানের ট্রেনার ও পরে তিনি কম্পোজারও হয়েছিলেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। তার নিজস্ব সংগীত-রীতি নজরুল-গীতি নামে পরিচিত।

নজরুল বিংশ শতকের হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির যুগ্ম প্রতিনিধি। তিনিই বাংলা গানে প্রথম পেশাদারী শিল্পী। বেতার, গ্রামোফোন ও চলচ্চিত্রে তিনি অবিরল গান লিখে জীবিকা নির্বাহ করেন। অবশ্য দেশপ্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত টানে তিনি বহু জাতীয় সংগীত লিখেছেন অপেশাদারী মনোভাব থেকে, আমাদের জাতীয় জীবনের নানা ঘটনার সূত্রে। সে সব গান স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালীকে উদ্বুদ্ধ  করেছে বারবার।

কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত সৃজন সামর্থ্যে বাঙালিকে আত্মহারা উদ্বেলিত করেছে। সম্ভবত তার গানের সংখ্যা তিন সহস্রের বেশি। যা বৈচিত্র্যে ব্যাপক, বিষয়ে বিচিত্র এবং রূপকল্পে বহুধা বিভক্ত। রাগ সংগীত থেকে লোকসংগীত, ভক্তি সংগীত থেকে স্বদেশী সংগীত, ভজন থেকে গজল -সব বিষয়েই ছিল তার অত্যাশ্চর্য দক্ষতা। রেকর্ড কোম্পানির ট্রেনার-রূপে বহু ধরনের গান তাকে লিখতে হয়েছে, তাতে সংযোগ করতে হয়েছে জনচিত্তজয়ী সুরের যাদু, সেই গান গাওয়াতে হয়েছে নতুন নতুন শিল্পী দিয়ে।

কাজী নজরুল ইসলাম নিজেও গাইতে পারতেন তীব্র উন্মাদনায়, অন্যের মধ্যে সঞ্চার করতে পারতেন দুর্বার আবেগ। আধুনিক বাংলা গানের বিষয়গত বিপুল বৈচিত্র্য, সুর তালের নিরীক্ষা এবং জনপ্রিয় উপাদান দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা গান তাঁর রচনা থেকে সদর্থক প্রেরণা ও স্পষ্ট পথনির্দেশ পায়। নজরুল গীতি ক্রমশ হয়ে ওঠে এক সুনির্দিষ্ট রূপবন্ধ, এক অমোঘ গানের ঐতিহ্য। যার উন্মাদনা এখনও সজীব। বাঙালীর সবচেয়ে প্রিয়, উচ্ছল ও মুখর এই গীতকার ১৯৪২ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে হয়ে যান বাক্ ও চলৎশক্তিহীন। সেই অবস্থাতেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় তার প্রয়াণ ঘটে। নজরুল গীতির অনেক অনির্ভরযোগ্য সংকলন আছে, তবে বেশির ভাগ গানের স্বরলিপি নেই।[২]

তথ্যসূত্র

১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪।
২. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা গান, প্যাপিরাস, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা, ১৬৭-১৬৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!