কালীপ্রসন্ন সিংহ (ইংরেজি: Kaliprasanna Sinha; ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ – ২৪ জুলাই ১৮৭০) ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ একজন লেখক ও নাট্যকার যিনি সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের বিখ্যাত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নন্দলাল সিংহ। বাল্য বয়স থেকেই কালীপ্রসন্ন অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। বালকের মাথায় বৃদ্ধের মস্তিষ্ক বললে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। অতি অল্প বয়সেই বিভিন্ন ভাষা ও বিষয়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েও প্রথাবদ্ধ পড়া সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। তবে কলেজের অসম্পূর্ণ পড়া সম্পূর্ণ করেছিলেন একজন ইংরেজ গৃহশিক্ষকের সাহায্যে।
সামাজিক অবদানে কালীপ্রসন্ন সিংহ
বিদগ্ধ বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সভা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ ছিল স্বদেশের সর্ববিধ উন্নতি বিধান। তাই সভ্যদের আলোচনার মুখ্য বিষয়ই ছিল ভাষা সাহিত্য ও সমাজের নানাবিধ সমস্যা।
সনাতনপন্থী সমাজের গোঁড়ামি ও কুসংস্কার তাঁকে পীড়িত করত। দেশবাসীর মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও প্রগতিমুলক চিন্তার প্রসার ঘটাবার উদ্দেশ্যে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন সভার মুখপত্র বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা। পরের বছর গড়ে তোলেন বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার।
বস্তুত এসব উদ্যোগের মাধ্যমেই বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে কালীপ্রসন্নের আর্বিভাব সূচিত হয়। শিক্ষার প্রসার ও উন্নতির উদ্দেশ্যে পরে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সর্বতত্ত্ব প্রবেশিকা, বিবিধার্থ সংগ্রহ ও পরিদর্শক প্রভৃতি পত্রিকা। প্রাণিতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ ছিল এই সকল পত্রিকার প্রধান বিষয়।
দেশে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং অসহায় চাষীদের দুরবস্থা অবলম্বনে রায়বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্র রচনা করেছিলেন নীলদর্পণ নাটক, ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে এই নাটক বহুভাবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকটি ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন। বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন পাদ্রী লঙ সাহেব। এর জন্য ইংরাজ সরকারের আদালতে তাকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে হয়েছিল। জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ কালীপ্রসন্ন লঙ সাহেবের জরিমানার হাজার টাকা আদালতে জমা দিয়েছিলেন।
সমাজ হিতৈষী কালীপ্রসন্ন এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে হিন্দু পাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ মুখোপাধ্যায় ও তার পরিবারবর্গকে; মুখার্জীস ম্যাগাজিন-এর শচন্দ্র মুখার্জী, শিক্ষক রিচার্ডসন ও লঙ সাহেব প্রমুখদের বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত বিধবা বিবাহ প্রসারের তিনি ছিলেন একজন প্রধান উৎসাহী সমর্থক। তিনি বিধবা বিবাহকে জনপ্রিয় করবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্য বিদ্যাসাগর দেশব্যাপী যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন কালীপ্রসন্ন।
সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন প্রধানত নাটক রচনার মাধ্যমে। তার রচিত বাবু নাটক প্রকাশিত হয় ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তী তিন বছরে প্রকাশিত হয় বিক্রমোর্বশী, সাবিত্রী সত্যবান ও মালতীমাধব। তৎকালীন বাবু সম্প্রদায়ের রুচিবিকৃতি ও সাধারণ সমাজব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলির প্রতি কটাক্ষ প্রকাশ করেছেন বিদ্রুপাত্মক রচনা হুতোম প্যাঁচার নক্সা ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করে। হুতোম প্যাচা ছিল তারই ছদ্মনাম। নানাদিক থেকেই এই গ্রন্থ স্মরণীয়। বিশেষ করে সংস্কৃত শব্দ কন্টকিত ভাষার যার প্রচলন করার লক্ষ্যে এই গ্রন্থটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ এবং এ কারণেই বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয়।
মূল সংস্কৃত মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করে নিজ খরচে তা প্রকাশ করা কালীপ্রসন্ন সিংহের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই মহৎ কাজে তাকে উৎসাহিত করেছিলেন বিদ্যাসাগর স্বয়ং। তারই তত্ত্বাবধানে এবং হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতের সাহায্যে কালীপ্রসন্ন এই শ্রমসাধ্য দুরূহ কর্ম সম্পাদন করেছিলেন।
খুবই স্বল্প পরিসর জীবনে কালীপ্রসন্ন যেসব কাজ করেছিলেন তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। সমসাময়িক কালে তিনি ভাষা সাহিত্য ও সমাজ জীবনে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি সরকার কর্তৃক অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ও জাস্টিস অব দ্য পীস নিযুক্ত হয়েছিলেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই কালীপ্রসন্ন পরলোক গমন করেন।
তথ্যসূত্র
১. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ৫০-৫২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা উনিশটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।