প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা হচ্ছে অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা ও রাষ্ট্রনীতির সমষ্টি

প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা বা প্লেটোর দর্শন বিষয়ক চিন্তা (ইংরেজি: Philosophical ideas of Plato) হচ্ছে অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা, রাষ্ট্রনীতি, শিল্প ও সাহিত্য এবং অন্যান্য চিন্তার সমষ্টি। প্রাচীন গ্রিক দর্শনচিন্তার অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিভিন্ন রচনায় দার্শনিক চিন্তার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। দর্শনে তাঁর যেসব অবদান রয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।

প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা উদ্ভবের প্রেক্ষাপট

প্লেটো পেলোপনেশীয় যুদ্ধের পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন। এই সময় অভিজাত পরিবারের সন্তান প্লেটো অভিজাত শ্রেণির সংকট প্রত্যাশা করেন। গ্রিক সমাজের সংহতি বিনষ্ট হয়েছিল। এই রকম পরিবেশে জনসাধারণের মনে বিপ্লবাত্মক চেতনার উদ্ভব ঘটে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হ্রাস পায়, চিন্তায় ও কর্মে ব্যক্তি স্বাধীনতার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ব্যাক্তি স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রের ওপরে স্থান দেওয়া হয়, আবির্ভাব হয় সফিস্ট দর্শনের। এই সফিস্ট দর্শনের বিরােধীতা করে এবং পূর্ববর্তী দার্শনিকদের প্রভাবে প্লেটোর দর্শন চিন্তা গড়ে ওঠে।

আইওনীয় দর্শন গ্রিসের প্রাচীন দর্শন। থেলিস (৬২৪-৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব), অ্যানাক্সিমান্দার (৬১১-৫৪৭ খ্রিস্টপূর্ব) এবং অ্যানাক্সিমিনিস (৫৮৮-৫২৪ খ্রিস্টপূর্ব) হলেন প্রখ্যাত আইওনীয় দার্শনিক। এঁরা প্রত্যেকেই সৃষ্ঠির উৎস জানার চেষ্ঠা করেন। থেলিস মনে করেন বিশ্বজগৎ উদ্ভবের প্রধান কারণ জল, যদিও অ্যানাক্সিমিনিস বায়ু এবং অ্যানাক্সিমান্দার অনির্দিষ্ট কোনো বস্তুকে সৃষ্টির জন্য দায়ী করেন। তবে পিথাগোরাসের মতে সৃষ্ঠির প্রধান কারণ সংখ্যা। তার মতে গাণিতিক পদ্ধতিজাত জ্ঞান অভ্রান্ত, গাণিতিক সংখ্যাগুলি চিরন্তন সত্যের উদাহরণ।

পিথাগোরাসের চিরন্তন সত্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্লেটো তার Idea বা আদর্শ তত্ত্ব গড়ে তোলেন। এলিয়াটিক দার্শনিক পার্মেনিদিসের (৫৪০-৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) দ্বারাও প্লেটো প্রভাবিত হয়েছিলেন। পার্মেনিদিস মনে করতেন ক্রমাগত পরিবর্তনশীল জগৎ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান সম্ভব নয়। জ্ঞান একমাত্র যুক্তির মাধ্যমেই লাভ করা যায়। সফিস্ট দার্শনিক প্রোটোগোরাস (৪৯০-৪২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মনে করেন, সার্বিক বলে কিছু হয় না, অনুভূতির দ্বারাই সত্যকে লাভ করা সম্ভব। বাস্তবে সত্য একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে মানুষ একমাত্র নিজেকে জানতে পারে, সমস্ত বাস্তবকে জানা সম্ভব নয়। সফিস্টরা সার্বিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তাঁরা মনে করতেন সার্বজনীন বলে কিছু হয় না। এর বিরোধীতা করেই প্লেটো তার দর্শন গড়ে তোলেন।[১]

প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা

জ্ঞানতত্ত্ব

প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব (ইংরেজি: Platonic epistemology) হচ্ছে, দার্শনিক আলোচনায়, গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং তার অনুসারীদের দ্বারা বিকশিত জ্ঞানের একটি তত্ত্ব।

মূল নিবন্ধ: প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব

জ্ঞানতত্ত্বে প্লেটো একটা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করেছেন। এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দুটি দিক। একদিকে আমরা ক্রমাধিক সাধারণীকরণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্যে আরোহণ করি। অপরদিকে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্য থেকে ক্রমান্বয়ে অল্প থেকে অল্পতর সাধারণ সত্যের মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন বিশেষ সত্য বা ভাবে আরোহণ করি।

প্লেটোর পূর্ববর্তী প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের দর্শন প্রধানত প্রকৃতিবাদী ছিল। সেই প্রকৃতিবাদী দর্শনে বস্তুর সত্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করা হয় নি। কিন্তু প্লেটো তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে সমালোচনা করে ভাববাদী তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁর মতে দৃশ্য জগতের বস্তু সত্য নয়। দৃশ্য জগতের বস্তু হচ্ছে খন্ড সত্য। সমস্ত সৃষ্টির পিছনে এক সত্তা আছে যার চরিত্র বস্তুগত নয়। মূল সেই সত্তা হচ্ছে অ-বস্তু ও ভাব। দৃশ্য বস্তু হচ্ছে সেই ভাবের প্রকাশ। ভাব হচ্ছে অবিনশ্বর এবং অতিন্দ্রিয়। মূল সত্তা রূপ ভাবের কোনো সৃষ্টি কিংবা ক্ষয় নেই। স্থান এবং সময়ের উপরও সে নির্ভর করে না। এই ভাবকে প্লেটো আবার বিশ্বের আত্মা বলেও অভিহিত করেছেন। এই বিশ্ব আত্মার খন্ড প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির আত্মার মধ্যে। আমাদের জ্ঞানের সঠিকতা নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মার পক্ষে বিশ্ব আত্মাকে আপন স্মৃতিকে ভাস্বর করে তোলার মধ্যে।

গ্রিসের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল দাসের এবং অপরাপর শ্রমজীবি মানুষের শোষণ। প্লেটো নিজে ছিলেন অভিজাত শাসক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ‘লজ’ বা বিধান এবং ‘রিপাবলিক’ নামক সংলাপে তিনি যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন তার ভিত্তিও তাই দাসের শ্রম। রাষ্ট্রের শাসক হবে তাই দার্শনিক সম্প্রদায়। তার রক্ষক হবে সেনাবাহিনী।

দার্শনিক এবং সামরিক বাহিনী—এরাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সত্তার অধিকার ভোগকারী স্বাধীন নাগরিক। এদের নিচে অবস্থান হচ্ছে দাস এবং শ্রমজীবি কারিগরের। তারা শ্রম করে শাসন দার্শনিক এবং রক্ষক সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করবে। শাসক দার্শনিকদের জীবিকার জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। তাদের কোনো ব্যক্তিগত পরিবার বা সম্পত্তি থাকবে না। কিন্তু তাই বলে তাদের কোনো কিছুর অভাবও থাকবে না। অভাবহীন অবকাশে তারা শাসনের কৌশল আয়ত্ত করবে এবং এইভাবে শাসন বিশেষজ্ঞ হয়ে শাসনক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হবে। শিশুকাল হতে শাসকসম্প্রদায়ের সন্তানকে এক সার্বিক শিক্ষার মাধ্যমে শাসক হওয়ার উপযুক্ত গুণে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে।

প্লেটো যেভাবে রাষ্ট্রের শাসন, রক্ষণ এবং উৎপাদনমূলক কাজকে পৃথক করে এক এক সম্প্রদায়ের উপর নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে শ্রমবিভাগের গুরুত্ব যে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু প্লেটোর শ্রমবিভাগ এবং আধুনিককালের শ্রমবিভাগ অবশ্যই পৃথক। প্লেটো্ তাঁর এই বিভাগকে কার্যত অনড় শ্রেণিবিভাগে যেমন পরিণত করেছিলেন, তেমনি এই বিভাগকে একটিকে অপর একটি থেকে উত্তম এবং অধম বলেও নির্দিষ্ট করেছিলেন। শাসনের কাজ হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ। আর শ্রম দিয়ে উৎপাদন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও মূল্যায়নের দিক থেকে অধম কাজ। প্লেটোর ভাবগত দর্শন আর সমাজগত তত্ত্ব উভয়ই পরবর্তীকালের ভাববাদী চিন্তার বিকাশে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে।[২]

তথ্যসূত্র

১. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ২।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৩১১-৩১২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!