এরিস্টটলের দর্শনচিন্তা যুক্তিবিদ্যা, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা এবং প্রাকৃতিক দর্শনে ব্যাপ্ত

এরিস্টটলের দর্শনচিন্তা (ইংরেজি: Philosophical ideas of Aristotle) যুক্তিবিদ্যা, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা এবং প্রাকৃতিক দর্শনে ব্যাপ্তিলাভ করেছিল। এরিস্টটল ছিলেন একজন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক যিনি দার্শনিক ও রাষ্ট্র চিন্তাধারার ভিত্তিতে অবদান রেখেছিলেন। তিনি দর্শনের অধিবিদ্যা নামে পরিচিতি শাখায় উন্নতি ঘটান। তিনি তাঁর শিক্ষক ও পরামর্শদাতা প্লেটোর ভাববাদ থেকে দূরে সরে গিয়ে বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে আরও অভিজ্ঞতাবাদী এবং কম রহস্যময় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে অগ্রসর হন।

এরিস্টটল ছিলেন প্রথম দার্শনিক যিনি সৎ নীতিশাস্ত্রের তত্ত্বকে গুরুত্ব সহকারে এগিয়ে নিয়েছিলেন, যা সমসাময়িক দার্শনিকদের দ্বারা নৈতিক চিন্তার তিনটি প্রধান স্কুলের মধ্যে একটি হিসাবে রয়ে গেছে। এই সমস্ত অবদানের সাথে, তিনি অন্তত অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ছিলেন।

এরিস্টটলের দর্শনচিন্তা

এরিস্টটলের দর্শন এবং চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রকৃতিক রহস্য ভেদে তাঁর অভিমত প্রধানত বস্তুজগৎ এবং বস্তুজগৎ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিছক কল্পনার উপর নয়। কিন্তু প্লেটোর ভাববাদী প্রভাব তিনি সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে সক্ষম হন নি। এ কারণে এরিস্টটলের দর্শনে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের মিশ্রণ দেখা যায়।

প্লেটোর মত এরিস্টটলও ভাববাদী দার্শনিক ছিলেন এবং আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে তিনি পার্থক্য করেছেন। তিনি নীতিগত দিক থেকে নয়, বাস্তবের প্রেক্ষিতে কোনটি ভাল তা বিচার করতে চান। এরিস্টটলের মত হলো বিশুদ্ধ বিশেষ যেমন দ্রব্য নয়, তেমনি বিশুদ্ধ সামান্যও দ্রব্য নয়। বিশেষ এবং সামান্য পাশাপাশি থাকে। বস্তু বা দ্রব্য হলো সামান্য ও বিশেষের সমন্বয়।

এরিস্টটল মনে করেন, জগতের সবকিছুই সতত পরিবর্তনশীল। আজ যে শিশু কাল সে কিশোর হয়, কিশোর যুবায় পরিণত হয় আবার যুবা বৃদ্ধও হয়। এই সকল পরিবর্তন আকস্মিক নয়, কার্য কারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তিনি মনে করেন প্রতিটি বস্তুর একটি লক্ষ্য আছে, এই লক্ষ্য হলো বস্তুর মধ্যে নিহিত সম্ভাবনার চরম প্রকাশ এবং পরম লক্ষ্যকেই তিনি বস্তুর অন্তিম আদর্শ হিসেবে গণ্য করেন।

এরিস্টটলের মতে বস্তুমাত্রেরই তিনটি রূপ আছে। বস্তুত্ব, আকার, গতি বা লক্ষ্য। বস্তুর বস্তুত্ব একদিকে অনড়, গতিহীন; কিন্তু অপর দিকে বস্তুর বস্তুত্বের মধ্যে বস্তুত্ব আকার, গতি এবং লক্ষ্যও নিহিত বা সুপ্ত। যা বস্তুর আকার তা বস্তুর অন্তনির্হিত বা সুপ্ত শক্তিরই প্রকাশ। কিন্তু সে জন্য বস্তুর আকার এবং বস্তুর বস্তুত্ব এক নয়। আকার বস্তু থেকে পৃথক। আকার ব্যতীত বস্তু কল্পনা করা যায় না। আকারই বস্তুকে উপলব্ধির যোগ্য করে। এ কারণে আকার অবশ্যই অধিকতর সত্য এবং চিরন্তন। বস্তুর পরিবর্তন কিংবা ক্ষয় আছে। কিন্তু আকারের পরিবর্তন বা ক্ষয় নাই। আকার অনুযায়ী বস্তুকে আমরা উপলব্ধি করি, বস্তু অনুযায়ী আকারকে নয়। আকারের এইরূপ ব্যাখ্যায় এরিস্টটলীয় দর্শনের ভাববাদী বৈশিষ্ট্যটি প্রকট হয়ে দেখা দেয়। আকার থেকে এরিস্টটল সমগ্র সৃষ্টির মূল শক্তি হিসাবে অতিপ্রাকৃতিক ঈশ্বরের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বর হচ্ছে সমস্ত অস্তিত্বের গতির উৎস। কিন্তু ঈশ্বরের নিজের কোনো গতি নেই।

এরিস্টটলের দার্শনিক ব্যাখ্যায় সব সময় ঐক্য এবং পারস্পর্যের সাক্ষাৎ মেলে না। বস্তু থেকে আকারকে পৃথক ভাবলেও এরিস্টটল অন্যত্র প্লেটোকে এই কারণে তীব্র সমালোচনা করেছেন যে, প্লেটো সাধারণ ভাবকে (মনুষ্যত্ব, পশুত্ব ইত্যাদি) বিশেষ বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছেন। প্লেটোর সমালোচনা হিসাবে এক্ষেত্রে এরিস্টটল এরূপ অভিমত পোষণ করেন যে, বিশেষ থেকে সাধারণ ভাবকে আদৌ পৃথক করা যায় না। বিশেষের মাধ্যমেই কেবল সাধারণ বা ‘নির্বিশেষ’ ভাবকে অনুধাবন করা চলে। প্লেটোর দর্শনের ক্ষেত্রে এরিস্টটলের এই সমালোচনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত এরিস্টটলের উপরোক্ত সমালোচনা ভাববাদের একটি মৌলিক সমালোচনা। এই সমালোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী বস্তুবাদী দর্শন বিকাশ লাভ করে।[১]

দেহের গবেষণা অর্থ্যাৎ চিকিৎশাস্ত্রেও এরিস্টটলের অবদান ষ্মরণীয়। তিনি দেহের প্রথম রোগ নিরাময়ের জন্য অস্ত্রোপচার এবং দেহ ব্যবচ্ছেদের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এরিস্টটলের পিতা নিজে চিকিৎসাবিদ ছিলেন। এরিস্টটলের শিশুকালে তিনি মারা গেলেও চিকিৎসা-বিজ্ঞানে গবেষণার পারিবারিক ঐতিহ্য হয়তো এরিস্টটলকে প্রভাবান্বিত করেছিল। পরিবারের মধ্যে বৈজ্ঞানিক পরিবেশ থাকার কারণে প্রতিটি বিষয় বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বিশ্লেষণের প্রতি এরিস্টটলের ঝোঁক দেখা যায়।

এরিস্টটল ও অনুমান দর্শন প্রসঙ্গে

এরিস্টটল যুক্তিশাস্ত্রের পিতা বলে স্বীকৃত। মানুষের চিন্তা ও তার প্রকাশকে বিশ্লেষণ করে সুশৃঙ্খলভাবে তার প্রকার নির্ধারণ ইউরোপীয় দর্শনের ক্ষেত্রে এরিস্টটলই সর্বপ্রথম করেন। যুক্তির মৌলিক বিধানগুলি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। এই বিধানগুলি প্রায় অপরিবর্তিতভাবে আজও যুক্তিশাস্ত্রে গৃহীত এবং আলোচিত হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ এবং তুলনামূলক আলোচনার শুরুও এরিস্টটলে।

বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা বিচার করে তিনি সমস্ত কিছু গ্রহণ করতেন, যা আরোহী (Inductive) নামে পরিচিত। এই পদ্ধতি একটি অনুমান গ্রহণ করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। আরোহী পদ্ধতির ওপর আসক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় তার পলিটিক্স গ্রন্থে। আরোহী পদ্ধতির আরো প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাই তার সমকালিন সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার তুলনামূলক ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মধ্যে। তবে সংবিধানগুলি অধ্যয়নের পাশাপাশি সেগুলির বিশ্লেষণও তিনি করেন। এককথায় তার রাজনৈতিক আলোচনার ভিত্তি হলো বস্তুবাদী চিন্তাধারা। বস্তুবাদী পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাল্পনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ও সেটিকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া তার সমর্থন লাভ করেনি। তিনি বাস্তব পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে বস্তুবাদী আলোচনা করার পক্ষপাতী ছিলেন।[২]

সত্তা, গুণ, পরিমাণ বা সংখ্যা, সম্পর্ক, স্থান কাল, অবস্থান, করণ, অধিকরণ ইত্যাদি জ্ঞানসুত্রগুলির গভীর দার্শনিক ব্যাখ্যা এরিস্টটল করেছিলেন। তাঁর সমস্ত সূত্রের অনেকগুলি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আজও প্রযুক্ত হচ্ছে। এরিস্টটলের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে, তাঁর সময় পর্যন্ত বিকশিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রকে তিনি সুসংবদ্ধ আকারে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এরিস্টটল থেকেই যে-কোনো সমস্যার সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্রপাত হয়েছে, একথা অবিসংবাদীরূপে সত্য।

এরিস্টটল রচনাবলী

এরিস্টটল কতগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তার সঠিক হিসেব আজ পর্যন্ত পন্ডিতেরা দিতে পারেননি। উইল ডুরান্ট এর মতে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪০০-এর কাছাকাছি। কেউ কেউ আবার বলেন সংখ্যাটা এক হাজারের কাছাকাছি। রাজতন্ত্র, নানাদেশের সংবিধান, উপনিবেশ প্রভৃতি সম্পর্কে তার লেখা গ্রন্থাবলী গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন। রাজনীতি সম্পর্কে তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো Politics। তার অধিকাংশ রচনায় আমরা তাঁর দর্শনের বাস্তব প্রয়োগ দেখতে পাই।

তথ্যসূত্র

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭।

২. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৮-৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!