প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র (ইংরেজি: Ideal state of Plato) হচ্ছে একটি কল্পলৌকিক সমাজ কাঠামো যার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি রাষ্ট্রকে সমাজের ক্রিয়াশীল আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্লেটোর অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে, “ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয় বরং রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি।” প্লেটো তাঁর ন্যায়তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় জনগণকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা- দার্শনিক শ্রেণি, যোদ্ধা শ্রেণি এবং উৎপাদক শ্রেণি। তিনি আদর্শ রাষ্ট্র বলতে বুঝিয়েছেন, যে রাষ্ট্রে এই তিনটি শ্রেণি তাদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সাথে পালন করে এবং একে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদন করে তাই আদর্শ রাষ্ট্র। অন্যভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ক্রমবিকাশের যে পর্যায়ে গিয়ে ন্যায়বিচার আবিষ্কৃত হয় সেটিই হলো প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের যথার্থ রূপ।[১]
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ধারণার কাল্পনিক পটভূমি
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি ইউটোপিয়া বা কল্পলৌকিক রাজ্য। দার্শনিক প্লেটো তৎকালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণার কাল্পনিক পটভূমি এঁকেছেন; যা তখনও বাস্তবে ছিল না এবং এখনও বাস্তবে পুরোপুরি নেই। গ্রিক সভ্যতার এক ক্রান্তিকালে তথা গ্রিক নগর সভ্যতা যখন অবক্ষয় আর অনিশ্চয়তার সম্মুখীন, যখন শাসকদল পরস্পর কোন্দলে লিপ্ত, গোষ্ঠী আর তন্ত্রের রদবদলে গ্রিক সমাজ রাহুগ্রস্ত, ঠিক সে সময়ে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা দেন।
প্লেটো তাঁর কাল্পনিক কাঠামোর মাধ্যমে নীতিগতভাবে দেখাতে চেয়েছেন, রাষ্ট্র কী রকম হওয়া উচিত। তিনি মূলত কল্পনায় রাষ্ট্রের মডেল দিয়েছেন। এজন্য W. A. Dunning তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রকে নিছক রোমাঞ্চ বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য আর্নেস্ট বার্কার এভাবে বলেছেন, “ক্রান্তিকালীন বিশ্বে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রকে ব্যবহারিক রাষ্ট্র সিস্টেমের জন্য একটি গাইড হিসাবে পরিবেশন করার উদ্দেশ্য থাকলেও, এটি সকলের কাছে আদর্শ নয়”।[২]
আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য
প্লেটো মনে করতেন, মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এবং সে কারণে বেঁচে থাকার জন্য যে সব প্রয়োজন মেটানোর দরকার হয় তা এককভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রত্যেককে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এইভাবে জীবন ধারণের জন্য মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে যৌথ জীবনযাপন করে। এই যৌথ জীবনের সাংগঠনিক রূপ হলো রাষ্ট্র।
প্লেটো এরকম রাষ্ট্রের আদর্শ রূপের কল্পনা করেছেন। প্লেটোর এই কল্পরাজ্যে আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তিশাসনের কথা বলেছেন। সেহেতু শাসক শ্রেণির সদস্যদের দীর্ঘমেয়াদী বহুমুখী শিক্ষাক্রমের মধ্যে দিয়ে আসতে হবে সেহেতু তিনি ভেবেছিলেন যে, যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত এই শ্রেণির মানুষরা কখনই কোনো অন্যায় করতে পারেন না। প্লেটো ভেবেছিলেন, আইনের শাসনের সুফল পাওয়া যাবে উপযুক্ত শিক্ষার অনুশাসনে। আর এই শিক্ষিত ব্যক্তিরা ব্যক্তি স্বার্থের পরিবর্তে সমাজের স্বার্থে শাসন পরিচালনা করবেন। তাই তিনি দার্শনিকদের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পনের সুপরিশ করে গেছেন, কারণ পার্থিব বিষয়ে দার্শনিকদের কোনো মোহ নেই। আদর্শ রাষ্ট্রের লক্ষ্য সৎ ও মহৎ নাগরিক তৈরি করা এবং তা দার্শনিক রাজার দ্বারাই সম্ভব। প্লেটোর মতে রাজা দার্শনিক হলে আইন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, কারণ দার্শনিক রাজার আদর্শ ও মহৎ জীবনযাপন প্রণালী জনসাধারণ অনুসরণ করবে।
ততকালিন বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য সুসংগত ও সংগঠিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেন। দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে নিষ্ঠুর ও কোমল আচরণের সেনাবাহিনীর কথা বলেন। তিনি আরো বলেন দেশকে রক্ষা করাই সেনাবাহিনীর কাজ, প্রশাসনে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। প্রত্যেক শ্রেণি নিজ নিজ শ্রেণির কাজ যথাযথ ভাবে পালন করলে বাস্তবিকই রাষ্ট্রব্যবস্থা আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে তিনি মনে করেন।
সুতরাং বলা যায় যে, প্লেটো সমাজে শৃঙ্খলা ও সংহতি আনার জন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা বলেন। প্লেটো বাস্তবে শ্রেণি বিভক্ত অসম সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিকতার মাধ্যমে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই তত্ত্বের মাধ্যমে দাসমালিকদের সমাজকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনি। আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদ ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে ফ্রিডরিখ হেগেল, টি. এইচ. গ্রিন, L.T. Hobhouse এবং আর্নেস্ট বার্কার প্রমুখরা প্লেটোর ভাববাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে অগাস্ট কোঁতে, এমিলি ডুর্খেইম বা ট্যালকট পারসনস-এর অনেকে আবার প্লেটোর ভাববাদী দর্শনকে বর্জনের চেষ্টা করেন, তবে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হতে পারেন নি। রাষ্ট্র দার্শনিক হিসেবে প্লেটোর কৃতিত্ব এখানেই যে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণ করেও তিনি আজও সমানভাবে সমাদৃত ও প্রাসঙ্গিক।[৩]
তথ্যসূত্র
১. মো. আবদুল ওদুদ, “প্লেটো”, রাষ্ট্রদর্শন, মনন পাবলিকেশন, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ; ১৪ এপ্রিল ২০১৪; পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭।
২. আর্নেস্ট বার্কার, গ্রিক রাজনৈতিক তত্ত্ব, পৃষ্ঠা – ১৯০
৩. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৬-৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।