পিথাগোরাস ছিলেন প্রাচীন আয়োনীয় গ্রিক গণিতবিদ ও দার্শনিক

পিথাগোরাস বা সামোসের পিথাগোরাস (জন্ম: আনু. ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, সামোস, আইনিয়া [গ্রীস] – মৃত্যু ৫০০-৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, মেটাপোঁটাম, লুসানিয়াম [ইতালি]) ছিলেন আয়োনীয় গ্রীক দার্শনিক, গণিতবিদ। তিনি পিথাগোরিয় ভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা প্রকৃতিতে ধর্মীয় হলেও, তাদের গঠিত নীতিগুলো এরিস্টটলের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল এবং গণিত ও পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শনের বিকাশে অবদান রেখেছিল।[১]

পিথাগোরাসের সাথে সবচেয়ে সুরক্ষিতভাবে চিহ্নিত শিক্ষণটি হ’ল মেটেমসাইকোসিস বা “আত্মার স্থানান্তর”। এই পাঠ ধারণ করে যে প্রতিটি আত্মা অমর এবং মৃত্যুর পরে, একটি নতুন দেহে প্রবেশ করে। তিনি ‘মিউজিকা ইউনিভার্সালিস’-এর মতবাদও তৈরি করতে পেরেছিলেন, যেটার মতে গ্রহগুলি গাণিতিক সমীকরণ অনুসারে চলে এবং এইভাবে সংগীতটির একটি শ্রবণাতীত সিম্ফনি তৈরি করতে অনুরণন ঘটায়।[২]

সমকোণীয় ত্রিভুজের ‘হাইপটেনিউজ’ বা অতিভুজ (সমকোণের বিপরীত বাহু)-এর বর্গ অন্য দুই বাহুর বর্গের যোগফল। জ্যামিতির অতি পরিচিত এই থিওরেম বা উপপাদ্য প্রত্যেক স্কুল ছাত্রকেই পড়তে হয়। কিন্তু উপপাদ্যটির আবিষ্কার আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, এ কথা ক’জন ছাত্রই বা জানে অথবা মনে রাখে? খ্রিস্টজন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগেই এটি আবিষ্কার করেছিলেন গণিতের এক বিরল প্রতিভা। তার নাম পিথাগোরাস; তাই এটি পিথাগোরিয়ান থিওরেম বা পিথাগোরাসের উপপাদ্য নামে বিখ্যাত। যে কোনও ত্রিভুজের তিনটি অন্তঃস্থ কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ বা ১৮০ ডিগ্রি, অবশ্যপাঠ্য এই উপপাদ্যটিরও আবিষ্কর্তা পিথাগোরাস।[৩]

যত দূর জানা গিয়েছে, পিথাগোরাস ষষ্ঠ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের শেষ ভাগে গ্রিসের সামোস-এ জন্মগ্রহণ খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৯ অব্দে এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ম্লেলারকাস ছিলেন রত্ন ব্যবসায়ী। সে সময় গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল সামোস। পিথাগোরাসের জীবনের বেশির ভাগটাই রহস্যে ঢাকা। তার সম্বন্ধে যেটুকু জানা গিয়েছে, তা উত্তরসূরিদের লেখা থেকেই। পিথাগোরাসের কাজ সম্পর্কেও একই কথা। তার সময়ে পার্চমেন্ট কাগজও তৈরি হয়নি। সুতরাং কিছু লিখে রেখে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পিথাগোরাস ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাই সেকালের সেরা শিক্ষার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, এটা অনুমান করা যায়। গণিতে তাঁর কাজই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সেরা শিক্ষা ছাড়া সেরা কাজ আদৌ সম্ভবপর নয়।

এটাও জানা গিয়েছে, বাল্যেই পিথাগোরাসের অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। পিথাগোরাসের বয়েস যখন ১৬-১৭, তখনই তার বহু প্রশ্নের জবাব দিতে পারতেন না শিক্ষকরাও। এর পরেই উচ্চতর শিক্ষার জন্যে তাকে প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ থেসের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই সময়েই পিথাগোরাস তার বিখ্যাত জ্যামিতিক উপপাদ্যগুলি রচনা করেন। আজকের দিনেও স্কুলে যে ধরনের জ্যামিতিক প্রমাণ পদ্ধতি শেখানো হয়, পিথাগোরাসই তার প্রবর্তক।

সে সময়ে বইপত্র ছিল না। শিক্ষক ছাত্রকে শেখাতেন মুখে মুখে এবং হাতে লিখে, কখনও ছবি ও স্কেচ এঁকে। বৃহত্তর শিক্ষার জন্যে দেশে দেশে ঘুরে পণ্ডিতদের সাহচর্য লাভ করা শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ ছিল। তাই এক সময়ে পিথাগোরাসও শিক্ষাভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। পারস্য, ব্যাবিলন, মিশর, এমনকী ভারতেও গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তিনি যখন ভারতে যান, সে সময়ে গৌতম বুদ্ধ তাঁর নতুন ধর্ম স্থাপন করছিলেন। সেই ভ্রমণ চলেছিল প্রায় ৩০ বছর ধরে।

এর মধ্যে বহু বছর মিশরে কাটান পিথাগোরাস। সেখানে সঙ্গীতের উপরেও পাঠ নেন। তিনি নিজেও একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। ‘লায়ার’ নামে এক রকমের তারযন্ত্র বাজাতেন। এই যন্ত্র তাঁর আজীবনের সঙ্গী ছিল। গাণিতিক সংখ্যার সঙ্গে সুরের সম্পর্কও বের করেন পিথাগোরাস। শোনা যায়, এক কামারের দোকানে নেহাইয়ের উপর হাতুড়ির আঘাতে সৃষ্ট বিভিন্ন সুর শুনে এর ধারণা তার মাথায় আসে। ব্যাপারটা কীরকম হতে পারে, একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝার চেষ্টা করা যাক। দুটি তার নেওয়া হলো, নাম ক ও খ। তার দুটি পাশাপাশি টান টান করে বাঁধা হলো। দুটি তারই একই ধাতুর তৈরি, সমান দৈর্ঘ্য এবং সমভর বিশিষ্ট। উভয়ের টানও সমান। এ বার কোনও বস্তু দিয়ে পর পর আঘাত করলে দুটি তার থেকেই একই ধ্বনি বা সুর বেরবে। এ বার ‘খ’ তারটির দৈর্ঘ্য অর্ধেক করে দিলে অর্থাৎ দুই তারের দৈর্ঘ্যের অনুপাত ২:১ হলে ছোট তারটি থেকে নির্গত সুরের তীব্রতা বড় তারের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। আসলে ছোট তারটি বাজবে উচ্চতর অষ্টকে। একটির সুরকে ‘সা’ ধরলে, অন্যটির সুর হবে উপরের বা চড়ার ‘সা’ (র্সা)।এইভাবে তারের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন করে বিভিন্ন স্কেলের সুর সৃষ্টি করা যায়। গণিতের সঙ্গে সুরের এটাই সম্পর্ক। এই সব অনুপাত বের করে সুরের স্কেল আবিষ্কার করেছিলেন পিথাগোরাস।

পিথাগোরাসের বয়স যখন ৫০, তার মধ্যেই সে সময়ে অধিতব্য গণিতের যাবতীয় শিক্ষাই তার সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি সমাধা হয়েছে নিজস্ব সৃষ্টিও। সংখ্যা নিয়েও গবেষণামূলক কাজ করেছিলেন পিথাগোরাস। পিথাগোরাস এবং তার অনুসারীদের মতে বিশ্ব অস্তিত্বের মূল হচ্ছে সংখ্যা। তাঁর অনুসারীগণ সংখ্যার উপর অলৌকিক ক্ষমতাও আরোপ করতেন। সংখ্যা ছিল তাঁদের কাছে শক্তির প্রতীক। বস্তুত সংখ্যার এই দর্শন কালক্রমে এই রহস্যময় ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপ গ্রহণ করে এবং পিথাগোরাস দক্ষিণ ইতালিতে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন গ্রিসে দাসের শোষণভিত্তিক সমাজে পিথাগোরাসের রহস্যবাদী সংখ্যা দর্শন এবং ধর্ম অভিজাত শাসকশ্রেণীর হাতিয়াররূপে ব্যবহৃত হয়।[৪]

পিথাগোরাস এবং তার অনুসারীরা মনে করতেন, সব কিছুতেই গণিত নিহিত। আর গণিতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো জ্যামিতি। বিশ্বাস করতেন, গাণিতিক সংখ্যার ব্যক্তিত্ব আছে, চরিত্র আছে, শক্তি ও দুর্বলতাও আছে। জোড় ও বিজোড় সংখ্যার বৈশিষ্ট পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। ত্রিভুজ, কোণ, ক্ষেত্রফল, অনুপাত, পলিগন বা বহুভুজ, পলিহেড্রন বা বহুতলক ইত্যাদি সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা দিয়ে গিয়েছেন পিথাগোরাস।

সামোসের অত্যাচারী শাসন এড়াতে পিথাগোরাস ৫৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইতালির ক্রোটনে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন এবং তৈরি করেন নিজস্ব একটি মেধাগোষ্ঠী, যা ‘পিথাগোরিয়ান ব্রাদার্স’ বা পিথাগোরীয় ভ্রাতৃসংঘ নামে পরিচিত হয়। এটি ছিল আধা বিজ্ঞান আধা ধর্মীয় একটি সংঘ। এই সংঘে তিনি প্রায় ৩০০ জন শিক্ষিত তরুণ ও পণ্ডিতদের শামিল করেন। এই গোষ্ঠী অবশ্য কালক্রমে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল এবং দক্ষিণ ইতালির গ্রিক কলোনিগুলিতে তার ব্যাপক প্রভাবও পড়েছিল।

রাজনীতি থাকলে তার বিপক্ষতাও থাকে। বিপক্ষের রোষে এক সময়ে পিথাগোরাসকে নির্বাসনেও যেতে হয়। কিন্তু এই পর্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। নির্বাসন কালেই ৮০ বছর বয়েসে তার মৃত্যু হয়। পিথাগোরাসের মৃত্যুর ২০০ বছর পরে রোমে তার মূর্তি স্থাপন করে তৎকালীন সেনেট। ‘গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ও সাহসী’ বলে অভিহিত করা হয় তাকে।[৩]

তথ্যসূত্র

১. The Editors of Encyclopaedia Britannica, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, https://www.britannica.com/biography/Pythagoras, সংগ্রহের তারিখ, ১৮ জুলাই, ২০২০।
২. অনুপ সাদি, ১৮ জুলাই ২০২০, “পিথাগোরাস ছিলেন প্রাচীন আয়োনীয় গ্রিক গণিতবিদ ও দার্শনিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/pythagoras/
৩. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৭-২৯।
৪. সরদার ফজলুল করিম, দর্শনকোষ, প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২, পৃষ্ঠা ৩২৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!