এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে বিপ্লববিরোধী অবস্থানে থাকার তত্ত্ব

এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব (Aristotle’s theory of revolution) হচ্ছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও সরকারের আমূল পরিবর্তনকামীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে বিপ্লববিরোধী অবস্থানে থাকার তত্ত্ব। রাষ্ট্রনীতির আলোচনা করেই দায়িত্ব শেষ করেননি, কিভাবে বিপ্লবের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিপ্লব কত রকমের হতে পারে তা তিনি আলোচনা করেছেন।

কতিপয় বিপ্লব বর্তমান সংবিধানকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে যার ফলে সংবিধানের প্রকৃতিই পরিবর্তিত হয়ে যায়; যেমন গণতন্ত্র থেকে গোষ্ঠীতন্ত্রে রূপান্তরিত। আবার বিপ্লবীরা অনেক সময় সংবিধান পরিবর্তন করতে চায় না, সরকারের পরিবর্তন চায়। প্রশাসনকে নিজের হাতে নেওয়ার জন্য বিপ্লবীরা বিপ্লবে আগ্রহী হয়। আবার অনেক সময় বিপ্লবী দল সরকার বা সংবিধান কোনোটারই পরিবর্তন করতে চায় না, যা আছে তারই চরিত্রকে পরিবর্তন করতে চায়। এছাড়াও অনেক সময় শুধুমাত্র সরকারের কোনো একটি অংশের পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব সংঘটিত হয়।

বিপ্লবের কারণ

এরিস্টটল তাঁরপলিটিক্স গ্রন্থের সমগ্র পঞ্চম খন্ড জুড়ে বিপ্লব সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই অংশে তিনি বিপ্লবের কারণগুলি আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন সাম্যের জন্য ব্যকুলতাই বিপ্লবের কারণ। তিনি বিপ্লবের কারণগুলিকে তিনটি ভাগে আলোচনা করেছেন। যেমন, 

i) মানসিক কারণ — যে মানসিক অবস্থার কারণে বিপ্লব হয়, 
ii) লক্ষ্য — যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিদ্রোহ বা বিপ্লব ঘটে,
iii) প্রাথমিক পরিস্থিতি — যে পরিস্থিতি রাজনৈতিক বিক্ষোভ এবং পারস্পরিক বিরোধিতা জন্ম দেয়।

এরিস্টটলের মতে, সাম্যের জন্য ব্যাকুলতা থেকে কেউ কেউ বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করে। সমতার জন্য ব্যাকুল ব্যক্তিরা যদি মনে করেন যে যোগ্যতা সমান হয়েও তিনি অন্যদের তুলনায় বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার কেউ যদি মনে করেন যে উৎকর্ষের বিচারে তারা অন্যের থেকে শ্রেয় এবং তা সত্ত্বেও অন্যের থেকে কম সুবিধা পাচ্ছেন, তাখন তারা বিপ্লবে যোগ দেন। আবার বিপ্লবের উদ্দেশ্যের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলি হলো লাভ এবং মর্যাদা এবং ক্ষতি ও অসম্মানের ভয়। আবার অনেক সময় ঔদ্ধত্য, মুনাফার ইচ্ছা, মর্যাদার প্রশ্ন, ভয়, ঘৃণা বা কোনো উপাদানের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির কারণে বিপ্লবের প্রাথমিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বিপ্লবের আপাত কারণ হিসেবে নির্বাচনী ষড়যন্ত্র, ইচ্ছাকত অমনোযোগিতা, রাষ্ট্রের গঠনের উপাদানের বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি কম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বর্ণ বা জাতিগত পার্থক্য, ভৌগোলিক কারণ এবং প্রেম সম্পর্কিত বিরোধেরও আলোচনা করেছেন।

বিপ্লবের কারণগুলি বিশ্লেষণের পর এরিস্টটল বিশেষ বিশেষ ধরণের রাষ্ট্র বা সাংবিধানিক ব্যবস্থায় কোন কোন কারণে বিপ্লব সংঘটিত হয় তা আলোচনা করেছেন। গণতন্ত্রে বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ জননেতাদের অসংযত আচরণ। অনেক সময় তারা সম্পত্তির মালিকদের বিরুদ্ধে ইর্ষার কারণে অভিযোগ আনে, ফলে সম্পত্তির মালিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়। কতিপয় তন্ত্রে পরিবর্তনের কারণ হলো জনগণের প্রতি সরকারের অন্যায় ব্যবহার। অভিজাততন্ত্রে পদ ও সম্মান ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, এর ফলে বঞ্চিতদের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, তখন বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এবং অভিজাততন্ত্র গণতন্ত্রে পরিণত হয়।

এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব বিপ্লব প্রতিরোধের উপায় আলোচনা করে

কীভাবে বিপ্লবের প্রতিরোধ করা যায় সে সম্পর্কে এরিস্টটল বেশ সচেতন ছিলেন এবং এই কারণে তিনি প্রতিরোধের নানা সুপারিশ করে গেছেন।

প্রথমত, ছোটোখাটো আইন লঙ্ঘন বা বিশৃঙ্খলা যাতে ব্যপক আবার ধারণ করতে না পারে রাষ্ট্র সেদিকে নজর দেবে। কারণ ক্ষুদ্র বিশৃঙ্খলা থেকে বৃহৎ বিশৃঙ্খলা জন্ম নিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, জনগণকে প্রতারিত করার কোনো চেষ্টা সরকার করবে না, জনগণ একদিন না একদিন সত্য জেনে যাবে এবং সরকারের ওপর আস্থা কমে যাবে।

তৃতীয়ত, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে, উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক বিপ্লব প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার।

চতুর্থত, সমাজে যারা প্রভাবশালী ও অভিজাত ব্যক্তি তাদের মধ্যে যেন অসন্তোষ দেখা না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, কারণ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিপ্লবের অনুগামী হলে অনেকেই তাদের অনুসরণ করবে।

পঞ্চমত, কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে অধিক সম্মান প্রদর্শন উচিত নয় তাতে অধিকাংশ জনগণ বিরূপ হয়ে উঠবে।

ষষ্ঠত, সমাজের মূলস্রোত থেকে জনগণ যাতে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায় সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে। আর সরকারি কর্মচারীদের উৎকোচ বা ঘুষ গ্রহণ থেকে নিরস্ত করতে হবে।

তথ্যসূত্র

১. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ১০-১১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!