প্লেটো ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের প্লেটোবাদী স্কুল ও একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা দার্শনিক

প্লেটো বা প্লাতো (ইংরেজি: Plato, আনু. ৪২৩ – আনু. ৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন প্রাচীন গ্রিসে ধ্রুপদী সময়কালের একজন এথেনীয় ভাববাদী দার্শনিক পশ্চিমা বিশ্বের উচ্চতর শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান, চিন্তার প্লেটোবাদী স্কুল ও একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রাচীন গ্রীক এবং পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর শিক্ষক, সক্রেটিস এবং তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র এরিস্টটলের সাথে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হন।[১]

জন্ম ও শিক্ষাজীবনে প্লেটো

প্লেটোর জন্ম হয় এথেন্সের এক অভিজাত পরিবারে। অভিজাত পারিবারিক মর্যাদার সঙ্গে মানানসই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন। সঙ্গীত, গণিত, কাব্য এবং অলংকার বিদ্যায় তিনি সমান পারদর্শিতা লাভ করেন। প্লেটোর পনেরো বছর বয়সে তিনি এথেন্সের সিসিলির বিরুদ্ধে বিরাট অভিযান এবং এই অভিযানে এথেন্সের পরাজয় প্রত্যশা করেছিলেন। এই অভিযান এথেন্সকে সামরিক ও আর্থিক দিক থেকে দুর্বল করে তোলে। এর ফলস্বরূপ দেশে অশান্তির পাশাপাশি নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০৭ অব্দে প্লেটো সক্রেটিসের কাছে লেখাপড়া শুরু করেন, যে কারণে প্লেটোর চিন্তাভাবনায় সক্রেটিসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্লেটোর আঠাশ বছর বয়সে সক্রেটিসের মৃত্যু হয়। তৎকালিন যে প্রজাতান্ত্রিক সরকার সক্রেটিসের প্রাণদন্ড দেয়, তার প্রতি তিনি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়ে পড়েন। কীভাবে এথেন্সে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই চিন্তায় মনোনিবেশ করেন। গুরু সক্রেটিসের জীবন রক্ষার চেষ্টার কারণে তিনি সরকারের বিরাগভাজন হন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে তিনি এথেন্স ত্যাগ করে দেশ ভ্রমণে বের হন। জ্যামিতি শাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কাছে তিনি শিক্ষা লাভ করেন এবং তাঁর চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পিথাগোরাসের দর্শন দ্বারাও প্রভাবিত হন। প্লেটোর ‘Republic’ ও ‘Statesman’ গ্রন্থের ওপর পিথাগোরাসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দশ বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭ অব্দে প্লেটো এথেন্সে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ‘অ্যাকাডেমি’ নামে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৭অব্দে প্লেটো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।[২]

প্লেটোর একাডেমি

প্লেটোর একাডেমি বা প্লেটোনিক একাডেমি (ইংরেজি: Platonic Academy) ছিলো আনুমানিক ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো দার্শনিক আলোচনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এরিস্টটল তার নিজের স্কুল লাইসিয়াম প্রতিষ্ঠার আগে বিশ বছর (৩৬৭–৩৪৭ খ্রিস্টপূর্ব) সেখানে অধ্যয়ন করেন। ৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লারিসার ফিলোর মৃত্যুর পর একাডেমীর ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এটি একটি সন্দেহবাদী স্কুল হিসাবে হেলেনিস্টিক সময় জুড়ে টিকে ছিল। ৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান স্বৈরশাসক সুল্লা কর্তৃক প্লেটোর একাডেমী ধ্বংস হয়।

প্লেটো রচনাবলী

প্লেটোর লিখিত রচনার সংখ্যা নেহাত কম নয়। তার যৌবনকালের রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলো – ‘Apology’, ‘Crito’, ‘Lysis’, ‘Charmides’, ‘Protagoras’ এবং ‘Laches’। প্রাপ্তবয়স্ককালে তিনি লেখেন ‘Parmenidis’, ‘Phaedo’, ‘Republic’ এবং ‘Symposium’। শেষ পর্বের রচনাগুলির মধ্যে ‘Statesman’ এবং ‘Laws’ উল্লেখযোগ্য। প্লেটো তাঁর ‘Republic’ গ্রন্থে ন্যায়ের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেন, ‘Statesman’ গ্রন্থে আইনের শাসন স্বৈরতন্ত্রের থেকে শ্রেয়, তা আলোচিত হয়েছে। আবার ‘Laws’-এ তিনি মিশ্র সংবিধানের কথা আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আলোচনায় উক্ত গ্রন্থগুলি গভীরভাবে সমাদৃত।

সক্রেটিসের নিজের কোনো রচনার কথা জানা যায় না। কিন্তু প্লেটো সক্রেটিসকে নায়ক করে বিপুল সংখ্যক সংলাপমূলক দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেন। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে রিপাবলিক, লজ, এ্যাপোলজি, ক্রিটো, ফিডো, পারমিনাইডিস, থিটিটাস প্রভৃতি সংলাপের নাম বিশেষ বিখ্যাত।

প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা

প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা বা প্লেটোর দর্শন বিষয়ক চিন্তা (ইংরেজি: Philosophical ideas of Plato) হচ্ছে অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা, রাষ্ট্রনীতি, শিল্প ও সাহিত্য এবং অন্যান্য চিন্তার সমষ্টি। প্রাচীন গ্রিক দর্শনচিন্তার অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিভিন্ন রচনায় দার্শনিক চিন্তার দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

প্লেটো পেলোপনেশীয় যুদ্ধের পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন। এই সময় অভিজাত পরিবারের সন্তান প্লেটো অভিজাত শ্রেণির সংকট প্রত্যাশা করেন। গ্রিক সমাজের সংহতি বিনষ্ট হয়েছিল। এই রকম পরিবেশে জনসাধারণের মনে বিপ্লবাত্মক চেতনার উদ্ভব ঘটে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হ্রাস পায়, চিন্তায় ও কর্মে ব্যক্তি স্বাধীনতার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই সময় ব্যক্তি স্বাধীনতার বিপরীতে প্লেটো সর্বাত্মকবাদী চিন্তা নিয়ে আবির্ভূত হন।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ১৪ আগস্ট ২০১৯, “প্লেটো ধ্রুপদী গ্রিসের দার্শনিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/plato/
২. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫।

রচনাকাল: ১৪ আগস্ট ২০১৯, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!