প্রাচীন গ্রিক দর্শন রোম সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দর্শন

প্রাচীন গ্রিক দর্শন বা প্রাচীন গ্রীক দর্শন (ইংরেজি: Ancient Greek philosophy) খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্থিত হয়েছিল। গ্রিক দর্শন অব্যাহত ছিলো হেলেনীয় কাল এবং সেই সময়ে যখন গ্রিস এবং বেশিরভাগ গ্রিক-আবাসিক ভূমিতে যেগুলো রোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। দর্শন অভিধাটি ব্যবহৃত হতো অ-ধর্মীয় উপায়ে বিশ্বের বিশ্লেষণ বোঝাতে। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, রাজনৈতিক দর্শন, নীতিশাস্ত্র, অধিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং নান্দনিকতা সহ বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে।[১]

কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মত এই যে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য নিসর্গ ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর অস্বাভাবিক সুসমঞ্জস মিলনই গ্রীকবাসীদের নিবিষ্ট চিন্তায় অনুরাগী করে তুলেছিল। ‘অত্যাশ্চর্য গ্রীক ব্যাপারের’ আত্মপ্রকাশে প্রাকৃতিক বিষয়গুলি অবশ্যই নির্দিষ্ট একটা ভূমিকা পালন করেছিল, কিন্তু যেভাবে বলা হয় সেভাবে নয়। 

গ্রীসে নিসর্গের বিপুল বৈচিত্র্য ও জলপথ ও খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব উৎপাদনের তীব্রতা বৃদ্ধিকে সহজতর করেছিল। দর্শন যখন আকৃতি লাভ করতে শুরু করেছিল সেই খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দকে বলা হয় লৌহযুগ যা পরবর্তী ব্রোঞ্জ যুগ থেকে যা পৃথক। আকরিক লোহা ও তামা নিষ্কাশন করা শুরু হয় এবং ধাতু গলনের নানান উপায় আবিস্কৃত হয়। ফসল বাড়ে, হস্তশিল্পের মান উন্নত হয়। মানুষ তার হাতকে ব্যবহার করেছিল যেন এক ‘দ্বিতীয় প্রকৃতি’ সৃষ্টি করার কাজে – শহর, উষ্ণ গৃহ, স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক পোশাক, ও উর্বর ক্ষেত্রের এক জগত সৃষ্টির কাজে, যা অহল্যা প্রকৃতির কাছ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন ও সুরক্ষিত করেছিল। মানুষের কাছ থেকে দুরে অপসত হওয়ায়, প্রকৃতি ক্রমে ক্রমে মানুষের চৈতন্যে তার মত বৈশিষ্ট্যগলি হারিয়ে এক সামান্যীকৃত রুপ ধারণ করেছিল।

ফলে, মনুষ্যজগতের বাইরে বিদ্যমান একটিমাত্র সমগ্র হিসেবে প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষ চিন্তা করতে শুরু করেছিল। প্রকৃতির কাছ থেকে তার ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতা তার মনেও তাকে পথক করা সম্ভব করে তুলেছিল। মানুষ আর নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করল না, চিন্তা করতে শুরু করল, কিসের জন্য সে তার একটি অংশ এবং তার থেকে তার প্রভেদ কিসে। 

দার্শনিক চিন্তনের বিকাশের উপরে বাণিজ্যের বৃদ্ধি ও মুদ্রা তৈরিরও বিরাট প্রভাব পড়েছিল। সমস্ত সামগ্রী সােনার বদলে বিনিময় হতে শুরু হয়েছিল। প্রাচীন গ্রীসবাসীরা বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন বস্তুর পিছনে একটিমাত্র সমগ্রকে দেখার এবং যে সমস্ত জিনিস বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় এক নতুন, সাধারণ গণ অর্জন করে পণ্যসামগ্রী হয়ে ওঠে, সেগুলির বিভিন্ন গুণ থেকে নিজেদের বিমূর্ত করে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল। ধাতব মুদ্রার আবির্ভাব গাণিতিক জ্ঞান এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। মানুষ যখন গণনাকার্যে নিযুক্ত থাকে, তখন বস্তুসমূহের বাহ্যিক চেহারা, সেগুলির রঙ, আয়তন ও উদ্দেশ্য থেকে নিজেকে বিমূর্ত করে নেয়: পরিমাণগত দিকটিতেই সে শুধু আগ্রহী থাকে। তাই যে কোনো অঙ্কই একটি বিমূর্তন। গণিতশাস্ত্রের বিকাশের সঙ্গে যে বিমূর্তনগুলি দেখা দেয়, সেগুলি দিয়ে কাজ করার সামর্থ্য দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত, কেননা প্রতিটি দার্শনিক মূল প্রত্যয় এক একটি বিমূর্তন।

পাটিগণিত ও জ্যোতির্বিদ্যাগত জ্ঞান, দুইই সুবিকশিত ছিল প্রাচ্যে – মিশর, আসিরিয়া, বাবিলোনিয়া ও ফিনিসিয়ায় – কেননা জমির জরিপ চালানোর জন্য এবং সূর্যগ্রহণের সময় হিসাব করার জন্য নীল নদে জল কখন বাড়বে ও কমবে তা হিসাব করে দেখা দরকার ছিল। কিন্তু এই জ্ঞানকে পুরোহিতরা গোপন করে রাখত, তারা এমন কি এক বিশেষ গুপ্ত বর্ণমালাও উদ্ভাবন করেছিল, যাতে বিজ্ঞান শুধু তাদের জাতেরই একান্ত বিশেষাধিকার হয়ে থাকে।

প্রাচীন গ্রিক দর্শন উদ্ভবের প্রেক্ষাপট

গ্রীক মহাজ্ঞানীরা তাঁদের জ্ঞানের অনেকখানিই নিয়েছিলেন প্রাচ্যের কাছ থেকে। এটা কোনোক্রমেই আকস্মিক ঘটনা ছিল না যে গ্রীক দার্শনিকদের প্রথম দলটি – থেলিস, এনাক্সিমান্ডার ও আনাক্সিমেনিস – এসেছিলেন গ্রীসীয় পৃথিবীর সীমা এশিয়া মাইনরের তটে অবস্থিত ইওনিয়া থেকে। কিন্তু গ্রীসে জ্ঞানকে পুরোহিতদের একান্ত বিশেষাধিকার করে রাখা হয় নি, আর এই জাতটিও কড়াকড়িভাবে বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী ছিল না, যেমন ছিল প্রাচ্যে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে এখানে এমন এক ‘ঈশ্বরের দান’ বলেও গণ্য করা হত না, যা বিকশিত বা উন্নত করা চলে না। তাই বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রটি ক্রমে ক্রমে সম্প্রসারিত হয়েছিল, এবং তার পদ্ধতিগুলি উন্নত করা হয়েছিল। আলাদা এক একটি ব্যাপারকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা থেকে গ্রীক চিন্তকরা এসেছিলেন বিদ্যমান সব কিছুর ‘মূলকথা ও কারণগুলির’ এক ব্যাখ্যার দিকে।

আমরা আস্থার সঙ্গে বলতে পারি যে একজন প্রাচীন গ্রীকের মন সত্তার সাধারণ সমস্যাবলীর মধ্যে ঢোকার জন্য প্রস্তুত ছিল। তবুও, চিন্তায় নিযুক্ত হতে হলে অবসর সময় থাকা দরকার। অবসর সময় কীভাবে দেখা দিয়েছিল এবং কে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারত তা বোঝার জন্য এমন সব জিনিসের দিকে চোখ ফেরানো যাক যেগুলি মনে হয় বিশুদ্ধ চিন্তার ক্ষেত্র থেকে বহু দূরবর্তী, যেমন উৎপাদন।

উৎপাদনে দ্রুত বৃদ্ধি ও সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি সমাজের এক বিশেষ অংশকে ক্ষেতে বা কর্মশালায় কাজ করা থেকে, কিংবা কায়িক প্রয়াস সংক্রান্ত অন্য কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব করে তুলেছিল। মস্তিষ্কের কাজকে কায়িক শ্রম থেকে পৃথক করা হয়েছিল। প্রাচীনরা মনে করত যে কিছু লোকের কাজ করাটা নিয়তি-নির্ধারিত, অন্যদের চিন্তা করা। স্বভাবতই, চিন্তা করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাদেরই ভাগ্যে যারা ছিল ক্রীতদাসের মালিক, চারণভূমি, দ্রাক্ষাকুঞ্জ প্রভৃতির মালিক, অর্থাৎ ধনী ব্যক্তি। প্রথম গ্রীক দার্শনিকরা সাধারণত এসেছিলেন ধনী ও সভ্রান্ত পরিবার থেকে। হেরাক্লিটাস, এম্পেডোক্লিস, ডেমোক্রিটাস, প্লেটো ও অন্য কয়েকজন গ্রীক চিন্তক সবাই ছিলেন অভিজাত।

তাই প্রাচীন গ্রিক দর্শন এমন এক সমাজে আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ লাভ সম্ভব করেছিল যেখানে কিছু লোকের হাড়ভাঙা দাসশ্রম অন্যদের সুযোগ দিয়েছিল অনধ্যানে নিজেদের সময় কাটাতে, অর্থাৎ এমন এক সমাজে যা ছিল শ্রেণিবিভক্ত। বিজ্ঞান, দর্শন ও কলাশিল্প পরবতী বহু শতাব্দী ধরে হয়ে উঠেছিল বাছাই-করা সংখ্যালঘিষ্ঠের বিশেষাধিকার।

দর্শন হলো একটি শ্রেণিভিত্তিক সমাজের উৎপাদিত দ্রব্য, যে সমাজে নিয়ত সংগ্রাম চলছে নিপীড়িত আর নিপীড়নকারীর মধ্যে, তথা শ্রেণিগুলির অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে, যেমন ভূস্বামী আর বণিকদের মধ্যে। এই সংগ্রাম প্রাচীন গ্রিসে জীবনের সমস্ত দিকের উপরে ছাপ ফেলেছিল, এবং দর্শনের বিকাশকেও প্রভাবিত করেছিল।[২]

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ১৩ আগস্ট ২০১৯, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/philosophy/ancient-greek/
২. গ. কিরিলেঙ্কো ও ল. করশুনোভা, দর্শন কী, প্রফুল্ল রায় অনূদিত, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ২৩-২৭

Leave a Comment

error: Content is protected !!