হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বা দ্বন্দ্ববাদ হচ্ছে বস্তু ও সমাজ সম্পর্কিত অভীক্ষার পদ্ধতি

দ্বন্দ্ববাদ বা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বা দ্বান্দ্বিকতা (ইংরেজি: Dialectics of Hegel) হচ্ছে ফ্রিডরিখ হেগেলের দর্শনের এক অভিনব বৈশিষ্ট্য। এটি অভিনব এজন্য যে, হেগেলই প্রথম তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে দ্বান্দ্বিক নামের এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি এমন একটি পদ্ধতি যে পদ্ধতিতে জগৎ সংসার সম্পর্কে সত্য অনুসন্ধানের নিমিত্তে সদর্থক (Positive)  ও নঞর্থক (Negative) এ দু’টি পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারার যে কোনো একটিকে অনুসরণ করে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। কোনো কিছু সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান অন্বেষণের জন্য সদর্থক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, সংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রচলিত ধ্যান ধারণার অসারত্ব প্রমাণপূর্বক সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে নঞর্থক প্রক্রিয়া। এখানে উল্লেখ্য যে, হেগেল সদর্থক প্রক্রিয়ার অর্থাৎ সদর্থক দ্বান্দ্বিক (Positive Dialectic) পদ্ধতির অনুসারী। তিনি বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতামত উপস্থাপন করেছেন।

দ্বন্দ্ববাদ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে হেগেল বলেন, বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পৃথিবী র্বতমান পর্যায়ে এসেছে। কেননা, পৃথিবী নামের এই গ্রহটি নিজে যেমন সর্বদাই গতিশীল, ঠিক তেমনি এর প্রকৃতি এবং মানুষও সর্বদাই গতিশীল বা পরিবর্তনশীল। আর এই গতিশীল বা পরিবর্তনশীল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমাজ ও সভ্যতাকে গতিশীল রেখেছে। ফলে অনুন্নত সমাজ উন্নত হয়েছে এবং মানুষ জটিলতাকে বর্জন করে সরলীকরণের দিকে ধাবিত হয়েছে। ইতিহাসের এই ক্রমবিবর্তনকে হেগেল দ্বন্দ্ববাদী পদ্ধতি বলে মত প্রকাশ করেছেন।

হেগেল এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, প্রকৃতি এবং মানব সমাজের প্রত্যেক অংশের বা সামগ্রিকের যে উন্নতি তা দ্বন্দ্ববাদী পদ্ধতির স্বাভাবিক ফলশ্রুতিমাত্র। কেননা, আজ যে ঘটনাকে নতুন বলে মনে হবে আগামীকাল তা কালের ধারায় হারিয়ে যাবে। আর এই সত্যকে কেউ অস্বীকার করলে সে তার অস্তিত্বকেই যে অস্বীকার করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

হেগেল বলেন, পরিবর্তনশীল সমাজ ও সভ্যতা ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে। আর সমাজ ও সভ্যতার এই বিকাশ লাভ সুনিয়ন্ত্রিত ও সুস্পষ্ট যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। হেগেল বলেন, সমাজ বিকশিত হওয়ার কাজটি দ্বন্দ্ববাদ পদ্ধতির আওতায় তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। ধাপ তিনটি হচ্ছে বিশ্লেষণ বা Thesis, প্রতিবিশ্লেষণ বা Antithesis, ও সংশ্লেষণ বা Synthesis. হেগেলের মতে, সমাজে ঘটমান প্রতিটি ঘটনাই কোনো না কোনো দিক থেকে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

এতে করে বিশ্লেষণ ও প্রতিবিশ্লেষণ মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধ বা সংঘাতের ফলেই নতুনের আবির্ভাব ঘটে। আবির্ভূত এই নতুনই কিন্তু সংশ্লেষণ। তাঁর মতামতের এই সারবত্তাকে উপরের মূল চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে।

হেগেলের মতে, বিবর্তনের ধারায় এক সময়ে আবির্ভূত নতুনই কোনো এক সময় একটি সাধারণ ধারণায় (Thesis) পরিণত হয়। আর এই সাধারণ ধারণার বিপরীতেই আবার জন্ম নেয় অন্য একটি ধারণার (Antithesis)। প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের আওতায় এই Thesis ও Antithesis এর মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলেই আবার আবির্ভাব ঘটে নতুনের বা সংশ্লেষণের। এমনিভাবে চক্রাকারে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলেই সমাজ ও সভ্যতা বিকশিত হতে থাকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, হেগেল তাঁর মূল দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে দ্বন্দ্ববাদ পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন এবং এতে কলা (Art) কে বিশ্লেষণ বা ধারণা, ধর্ম (Religion) কে প্রতিবিশ্লেষণ বা বিপরীত ধারণা এবং দর্শনকে সংশ্লেষণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, কলা ও দর্শন একই মুদ্রার এপিট ওপিঠ মাত্র। অর্থাৎ এ দুইয়ের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। তবে কলা ও দর্শন উভয়ের সঙ্গেই ধর্ম বিভেদক হিসাবে কাজ করে।

আরো পড়ুন

হেগেলের দ্বন্দ্ববাদী পদ্ধতির সমালোচনা

বাহ্যিকভাবে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান যাবতীয় ঘটনাবলির বিশ্লেষণে হেগেল প্রবর্তিত দ্বন্দ্ববাদ পদ্ধতিকে যথার্থ বলে মনে হলেও সমালোচকগণ নিম্নোক্ত যুক্তিতে হেগেলের দ্বন্দ্বদ্ববাদ পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন।

১. সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ লাভের বিষয়টিকে হেগেল হচ্ছে বিশ্লেষণ বা Thesis, প্রতিবিশ্লেষণ বা Antithesis, ও সংশ্লেষণ বা Synthesis এর মতো তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয় বলে যে মত প্রকাশ করেছেন ড. ম্যাকটেগার্ট ও অন্যান্য ভাববাদীরা সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, বিশ্লেষণ, প্রতিবিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণকে সব সময় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চিহ্নিত করা সত্যি সত্যিই সম্ভব নয়।

২। হেগেল তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের নিরিখে সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োগপূর্বক কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যুক্তিহীনেরা বলে যে, বাস্তবে প্রাকৃতিক ও সমাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।

৩। হেগেল মনে করতেন যে, বিবর্তনের ধারায় কেবলমাত্র মানুষের চিন্তা দ্বান্দ্বিক অগ্রসরের ধারাকে অনুসরণ করে চলে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের চিন্তা ছাড়া ব্যক্তিসত্তাও যে একই ধারা অনুসরণ করতে সক্ষম তা হৃদয়ঙ্গম করতে হেগেল ব্যর্থ হয়েছেন।

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, হেগেল তাঁর Phenomenology of Spirit নামক গ্রন্থে ধর্মকে কলা ও দর্শনের মধ্যকার বিভেদক বলে আখ্যায়িত করলেও কোন অর্থে ধর্ম, কলা ও দর্শনের বিভেদক তা ব্যাখ্যা করতে যে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তথ্যসূত্র:

১. মো. আবদুল ওদুদ (১৪ এপ্রিল ২০১৪)। “জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিক হেগেল”। রাষ্ট্রদর্শন (২ সংস্করণ)। ঢাকা: মনন পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮১।

2 thoughts on “হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বা দ্বন্দ্ববাদ হচ্ছে বস্তু ও সমাজ সম্পর্কিত অভীক্ষার পদ্ধতি”

  1. খুবই ভাল একটা প্রয়াশ। অব্যাহত থাকুক।

    Reply
  2. বিশ্লেষণ আরও বিস্তারিত দাবি করে। এরকম লেখা বেশ বেশি জরুরি।

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!