এরিস্টটল বা এ্যারিস্টটল বা আরিস্তোতল (ইংরেজি: Aristotle) (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ – ৭ মার্চ, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২) ছিলেন প্রাচীন গ্রিসে ধ্রুপদী সময়কালের একজন গ্রীক দার্শনিক এবং বহু বিষয়ে জ্ঞানী। তিনি প্লেটোর ছাত্র ছিলেন। পরে কিছুকাল আলেকজান্ডারের শিক্ষকতা করেন।[১] দর্শনের অন্যতম অঙ্গ রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে তাঁর বহুবিধ মৌলিক ভাবনা বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এরিস্টটলের অবদান অতুলনীয়। প্রাচীন গ্রিক দর্শন এরিস্টটলের হাতে চরম উৎকর্ষ লাভ করে।
এরিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন মেসিডোনিয়ায় স্ট্যাগিরা নামের একটি নগরে। তার পিতা মেসিডোনিয়ার রাজসভার চিকিৎসক ছিলেন। বাল্যকালে অল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর পিতা-মাতা উভয়ই মারা যান। এ সময় তাদের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় বা বাবার বন্ধু প্রক্সিনাস (Proxinus) তাঁর অভিভাবক হন। প্রক্সিনাস এরিস্টটলকে তাঁর পৈতৃক পেশায় শিক্ষিত করে তোলেন।
১৮ বৎসর বয়সে প্রক্সিনাস এরিস্টটলকে প্লেটোর একাডেমিতে শিক্ষালাভের জন্য পাঠান। এরিস্টটল প্রায় ২০ বৎসর প্লেটোর একাডেমিতে তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে কাটান। একাডেমিতে অবস্থানকালে এরিস্টটল একজন প্রতিভাবান ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং প্লেটোর দর্শনের একজন বিশেষজ্ঞে পরিণত হন। প্লেটো তাঁকে একাডেমির মগজ (brain) বলে উল্লেখ করেছেন। গুরুর দর্শনের সুস্পষ্ট জ্ঞান তাঁর মৌলিক দর্শন সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল। একাডেমিতে অবস্থানকালে তিনি সত্যিকার অর্থে দর্শনের অনুরাগী হয়ে উঠেন।
এরিস্টটল এথেন্স ত্যাগ করলেন
প্লেটোর মৃত্যুর পর একাডেমির অধ্যক্ষরূপে কে তাঁর স্থানে নির্বাচিত হবেন, এই প্রশ্ন দেখা দিল। সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন তিনজন। এরিস্টটল, জেনোক্রেটিস এবং প্লেটোর ভাইপো এসপিউসিপাস। এই তিনজনের মধ্যে ভাইপো এসপিউসিপাস (Speusippus) একাডেমির অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। এরিস্টটল জেনোক্রেটিসকে সঙ্গে নিয়ে এথেন্স ত্যাগ করলেন এবং অ্যাসস শহরে একাডেমির একটি শাখা স্থাপন করেন।
এখানে বাস করার সময় তিনি অ্যাটারনিয়াসের রাজা হারমিয়াসের উপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং তাঁর পালিত কন্যা পিথিয়াসকে বিবাহ করেন। কথিত আছে যে, পরবর্তীকালে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। দ্বিতীয় পত্নীর নাম ছিল হারপিলিস এবং এই পত্নীর গর্ভে নিকোমেকাস নামে তাঁর এক পুত্র জন্মে। অ্যাসস শহরে নিজ কার্যে নিযুক্ত থাকাকালীন এরিস্টটল তাঁর স্বাধীন মত প্রচার করতে থাকেন। তিন বছর পরে লেসবস (Lesbos) এ মাইটিলিন নামক এক স্থানে তিনি গেলেন। সেখানেই থিয়োফ্রাস্টাস (Theophrastus) এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, যিনি পরবর্তী সময়ে এরিস্টটলের একজন খ্যাতনামা শিষ্য হয়েছিলেন।[২]
লেসবস দ্বীপে অবস্থানকালে মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপ তাঁর ত্রয়োদশ বর্ষীয় পুত্র আলেকজান্ডারকে শিক্ষাদানের জন্য এরিস্টটলকে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তিনি রাজধানীতে যান ও আলেকজান্ডারের শিক্ষক নিযুক্ত হন।
এছাড়াও এরিস্টটল ম্যাসেডনের রাজকীয় একাডেমির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। ম্যাসিডোনিয়ান আদালতে এরিস্টটলের সময়, তিনি কেবল আলেকজান্ডারকেই নয়, ভবিষ্যতের দুই রাজাকেও শিক্ষা দিয়েছিলেন যাদের নাম টলেমি এবং ক্যাসান্ডার।
এরিস্টটল আলেকজান্ডারকে পাঁচ বৎসর শিক্ষা দান করেন। আলেকজান্ডারের সাথে তাঁর আজীবন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই আলেকজান্ডারই পরে দিগবিজয়ী বীরের খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর শিক্ষা আলেকজান্ডারের উপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল সে সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও হেলেনীয় সভ্যতা প্রসারে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল-এ ব্যাপারে অনেকে একমত। আলেকজান্ডারের ১৭ বৎসর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যুতে তিনি বিশাল মেসিডোনিয়ার শাসনকর্তা হন। মেসিডোনিয়া এবং মেসিডোনিয়ার সম্রাট ফিলিপ ও আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এথেন্স নগরীতে তাঁকে পরবর্তী জীবনে বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু মেসোডোনিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তারকেও এরিস্টটল সমর্থন করেন নি।
এরিস্টটল পুনরায় এথেন্সে আগমন করলেন
৩৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার সিংহাসনে বসলে তিনি এরিস্টটলকে এথেন্সে নিয়ে আসেন এবং লাইসিয়াম নামে এক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিক্ষাকেন্দ্রে দর্শন, সাহিত্য, বিমূর্ত অঙ্কশাস্ত্র অপেক্ষা বাস্তব গবেষণার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। ৩৩৫ থেকে ৩২৩ খ্রিস্টপুর্বাব্দে এথেন্সে থাকাকালীন এরিস্টটল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ রচনা করেন।
মূল নিবন্ধ: এরিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর এথেন্সে অরাজকতা শুরু হলে তিনি এথেন্স ত্যাগ করেন এবং ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন।[৩]
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, “এরিস্টটল ধ্রুপদী গ্রিসের দার্শনিক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/aristotle/
২. মো. আবদুল ওদুদ, “এরিস্টটল”, রাষ্ট্রদর্শন, মনন পাবলিকেশন, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ; ১৪ এপ্রিল ২০১৪; পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪।
৩. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।
অ্যারিস্টটল এর উপর আপনার লেখা জীবনবৃতান্ত অনেক তথ্যবহুল। অনেক অজানা কে জানলা। ধন্যবাদ আপনাকে।