এরিস্টটলের দাসতত্ত্ব বা দাস ব্যবস্থা (ইংরেজি: Aristotelian slavery বা Natural slavery) হচ্ছে দাসযুগের শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থনকারী মতবাদ। রাষ্ট্র দর্শনের ইতিহাসে এরিস্টটলের দাসতত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ‘দি পলিটিক্স’ গ্রন্থের প্রথম ভাগে দাসতত্ত্ব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। মানব জীবনের একটি ঘৃণ্য ও অমানবিক প্রথাকে সমর্থন করে এরিস্টটল উপস্থাপন করেছেন অকাট্য যুক্তি। তিনি নিজেই বলেছেন, “যে রাষ্ট্র দাস ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা নিজেই দাস”।
এরিস্টটলের সময় দাসপ্রথা একটি বিতর্কমূলক বিষয়ে পরিণত হয়। সোফিস্ট, স্টয়িক ও সিনিকরা দাস প্রথাকে জঘন্য প্রথা এবং তা মানুষে মানুষে অসাম্য আনবে বলেই তা বিরোধিতা করা হয়েছে। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সমকালীন সমালোচনা এরিস্টটলকে দাস প্রথার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে সমর্থন যুগিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শাসন ও অধীনতা নীতি অনুযায়ী উত্তম অধমকে শাসন করবে এবং অধম উত্তমের আজ্ঞা পালন করবে এটাই প্রকৃতির বিধান।”
এরিস্টটলের দাসতত্ত্ব কীভাবে সমর্থিত হয়েছে
পরিবার হলো রাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তিন ধরণের সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিবার গড়ে ওঠে — i) প্রভু-দাসের সম্পর্ক, ii) স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক এবং iii) পিতা ও সন্তানের সম্পর্ক। অর্থনৈতিক কার্যাবলীও পরিবারের আরেকটি উপাদান। সম্পদ সংগ্রহ পরিবারের একটি অর্থনৈতিক উৎস কারণ সম্পদ ছাড়া উত্তম জীবন সম্ভব নয়। আবার জীবনযাপনের উপায়ের সমষ্টি হলো সম্পদ এবং দাস সম্পদের অন্তর্গত। দাস হলো বাড়ির আসবাবের মতো। এই যুক্তির দ্বারা এরিস্টটল দাসকে প্রভুর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করেছেন। দাস ব্যবস্থাকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য তিনি বলেন, সমাজে শ্রেয়-অশ্রেয় পার্থক্য বর্তমান এবং শ্রেয় সবসময় অশ্রেয়কে শাসন করে যা উভয়ের পাশেই লাভজনক।
এরিস্টটল মনে করেন মানুষের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা কেবল শরীরটাকেই ব্যবহার করতে জানে, এর থেকে ভালো কিছু করার সামর্থ্য তাদের নেই। এই ধরণের মানুষই প্রকৃতিগতভাবে দাস। শিকারে পশুশিকার যেমন সঙ্গত তেমনি প্রকৃতিগতভাবে যে দাস সে যদি বশ্যতা স্বীকার না করে তখন তাকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করাই ন্যায্য বা যুক্তি সঙ্গত। এরিস্টটল মনে করেন গৃহপালিত পশুর সঙ্গে দাসের কোনো পার্থক্য নেই। প্রকৃত দাস এবং স্বাধীন নাগরিকদের দেহ পৃথকভাবে গঠন করেছে, দাসের শরীর কায়িক পরিশ্রম করার মত শক্তপোক্তভাবে গঠিত। দাসের পক্ষে দাসত্ব কল্যাণকর, কেননা সে উন্নততর মালিকের কাছে থেকে উৎকর্ষতা, নৈতিকতা লাভ করে থাকে।
প্রাচীন গ্রীসে যুদ্ধবন্দীদের দাস করার নিয়ম ছিল। এরিস্টটল মনে করতেন ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে যারা বন্দী হয়ে তাদের দাস হিসেবে গণ্য করাই সঙ্গত। বিজয়ী যদি বৌদ্ধিক মানের দিক থেকে উৎকর্ষতার অধিকারী হয়, তাকেই বিজিতদের দাস বানানো যেতে পারে নতুবা নয়। কিন্তু যারা প্রকৃতিগতভাবে প্রভু হবার উপযুক্ত তাদের যুদ্ধের মাধ্যমে দাসে পরিণত করা উচিত হবে না। কিন্তু বর্বরদের দাসে পরিণত করা যাবে। প্রভু ও দাসের স্বাভাবিক সম্পর্কে এরিস্টটলের কোনো সন্দেহ ছিল না। তিনি মনে করতেন দাস প্রভুর অংশ – তার দেহের সজীব অংশ। এছাড়াও তাঁর বক্তব্য হলো যেহেতু প্রকৃতি একজনকে দাস এবং অপরকে প্রভু হিসেবে নির্দিষ্ট করেছে তাই উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকাই সুবিধাজনক। এরিস্টটল অবশ্য স্বীকার করেছেন যে শক্তি ও প্রথার মাধ্যমে যাদের দাসে রূপন্তরিত করা হয় তাদের মধ্যে ওই সম্পর্ক থাকে না।[১]
তথ্যসূত্র
১. গোবিন্দ নস্কর, রাষ্ট্রচিন্তা, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৮-৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।