প্লেটোর একাডেমি ছিলো প্লেটো প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক আলোচনার একটি প্রতিষ্ঠান

প্লেটোর একাডেমি বা প্লেটোনিক একাডেমি (ইংরেজি: Platonic Academy) ছিলো আনুমানিক ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো দার্শনিক আলোচনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এরিস্টটল তার নিজের স্কুল লাইসিয়াম প্রতিষ্ঠার আগে বিশ বছর (৩৬৭–৩৪৭ খ্রিস্টপূর্ব) সেখানে অধ্যয়ন করেন। ৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লারিসার ফিলোর মৃত্যুর পর একাডেমীর ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এটি একটি সন্দেহবাদী স্কুল হিসাবে হেলেনিস্টিক সময় জুড়ে টিকে ছিল। ৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান স্বৈরশাসক সুল্লা কর্তৃক প্লেটোর একাডেমী ধ্বংস হয়।[১]

গ্রিক ‘একাডেমীয়া’ শব্দ থেকে ইংরেজি একাডেমি শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের একটি বাগানকে একাডেমাসের বাগান বলা হয়। পূর্বে এই বাগানে গ্রিক দেব-দেবীদের উদ্দেশে পশু উৎসর্গ করা হতো।

এথেন্সের একাডেমির ইতিহাসে তিনটি পর্যায়ের কথা জানা যায় (১) প্রথম পর্যায় বা প্লেটো পর্ব। প্লেটো পর্বে প্লেটোর পরে স্পুসিয়াস, জেনোক্রাটিস এবং পলেমনকে একাডেমির সঙ্গে যুক্ত দেখো যায়। (২) দ্বিতীয় পর্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আরসেসিলাস পরিচিত। এটাকে একাডেমির মধ্যযুগ বলেও অভিহিত করা হয়। এই যুগে আলোচনার লক্ষ্য ছিল প্রাচীন স্টোয়িক বা প্রতিরোধহীন সমর্পণবাদকে খণ্ডন করা হয়। আরসেলিলাসের পরে আসেন ল্যাসিডিস। (৩) তৃতীয় পর্যায়কে একাডেমির নবপর্যায় বলেও অভিহিত করা হয়। এই পর্বের প্রধান উদ্যোগী চিন্তাবিদ ছিলেন কারনিয়াডিস। কারনিয়াডিসের চিন্তাধারা পূর্বতন সন্দেহবাদের প্রকারবিশেষ।

প্লেটো ৩৪৭ খ্রি.পূ. অব্দে মারা যান। প্লেটোর মৃত্যুকাল পর্যন্ত দার্শনিক এরিস্টটল একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে অন্যান্য দার্শনিক যাঁরা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে জ্যোতির্বিদ ইউডোক্সাস এবং ফিলিপাস, গণিত শাস্ত্রবিদ থিটিটাস এবং একাধারে সমাজতত্ত্ববিদ, ভূগোলবিদ এবং বৈজ্ঞানিক হিরাক্লিডিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম যুগকেই একাডেমির স্বর্ণযুগ বলা যায়। এই যুগে একাডেমির সদস্যগণ প্রতিষ্ঠানটিকে একটি মুক্তবুদ্ধি গবেষণা এবং দর্শন সম্পর্কিত আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। এই যুগে মতামতের দ্বন্দ্বে দেখা যায় যে, স্পুসিপাস প্লেটোর বস্তুনিরপেক্ষ ‘পরমভাব’-এর ধারণাকে খণ্ডন করে ‘আংকিক সংখ্যাই হচ্ছে একমাত্র নিত্যসত্য’- পাইথাগোরীয় সম্প্রদায়ের এই অভিমতকে সমর্থন করেছেন। পুসিপাস আরো দাবি করেন যে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা সত্যজ্ঞান লাভ করতে পারি। প্রাকৃতিক জগতের ইতিহাস বর্ণনাতেও স্পুসিপাসের আগ্রহ ছিল।

একাডেমির আদি যুগের অন্যতম দার্শনিক জেনোক্রাটিস প্লেটোবাদ এবং পাইথাগোরীয়বাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি একদিকে প্লেটোর নিকট থেকে সমস্ত অনিত্য প্রকাশের পেছনে এক নিত্য সত্তার অস্তিত্বকে গ্রহণ করেন, অপরদিকে নিত্য এবং অনিত্যের সংঘাতে সংখ্যার উৎপত্তি হয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। খ্রিস্টাব্দের চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে একোডেমির মতাদর্শ নব-প্লেটোবাদ বলে পরিচিত হয়। ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান একাডেমির আলোচনা নিষিদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেন। ইউরোপে নব জাগরণের যুগে (১৪৫৯-১৫২১) ফ্লোরেন্স শহরে ‘একাডেমি’ নামে আলোচনা ও গবেষণার নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। এই পর্যায়ে প্লেটোর রচনাবলীর উদ্ধার এবং অনুবাদ এবং এ্যারিস্টটলের দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যা গুরুত্ব লাভ করে।

‘একাডেমি’ বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শব্দ। একাডেমি শব্দ দ্বারা সাহিত্য, শিল্প এবং বিজ্ঞানের আলোচনা ও গবেষণার কেন্দ্রে বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝান হয়। এই অর্থে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ‘একাডেমি’ নামক প্রতিষ্ঠানকে কার্যরত দেখা যায়। বিশ্বের বিখ্যাত একাডেমিগুলির মধ্যে ফরাসি একাডেমি, ইংল্যাণ্ডের ব্রিটিশ একাডেমি, গ্রিসের একাডেমিয়া এথেন্স, জাপানের দি ন্যাশনাল একাডেমি অব জাপান, আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউইয়র্ক একাডেমি অব সায়েন্সস এবং রাশিয়ার একাডেমি অব সায়েন্সস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমিও একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান।[২]

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ১৫ মার্চ ২০১৯, “প্লেটোর একাডেমি ছিলো দার্শনিক আলোচনার একটি প্রতিষ্ঠান”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/encyclopedia/philosophical-glossary/platonic-academy/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২০

Leave a Comment

error: Content is protected !!